ভণ্ড দেশপ্রেমিক সেজে আর কতদিন?


প্রকাশিত: ০৪:২৫ এএম, ০৪ ডিসেম্বর ২০১৬

গত কয়েক বছর ধরে ‘দেশপ্রেম’ শব্দটা শুনলেই কেমন জানি লাগে! চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফেসবুকের হোমপেজে হাজার হাজার ‘বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা’, ‘স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা’, ‘মাতৃভাষা দিবসের শুভেচ্ছা’। সত্যিই তো এসব না থাকলে কি দেশপ্রেমের প্রমাণ পাওয়া যায়? একজন মানুষকে কীভাবে বোঝানো সম্ভব যে আদৌ আমি দেশপ্রেমিক নাকি রাজাকার? এখন তাই দেশকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসার চেয়ে নিজেই নিজেকে জাহির করা ‘দেশপ্রেমিক’র সংখ্যা বেশি।

আমি বলছি না যে, এসব যারা লেখেন তারা দেশকে ভালোবাসেন না। দেশকে ভালোবাসার সঙ্গে এসব শুভেচ্ছাবার্তা লেখার কোনোই সম্পর্ক নেই। কিন্তু মৌলবাদী দেশপ্রেমিক হলে সমস্যা আছে, মারাত্মক সমস্যা! কেউ দেশের পতাকাকে জায়নামাজ বানিয়ে নামাজ পড়লে কি দেশকে, দেশের পতাকাকে অসম্মান করা হয়? জায়নামাজে তো বিভিন্ন মসজিদের মিনার, গম্বুজ ইত্যাদির নকশাও থাকে। মসজিদের মিনারের ওপর পা রাখা কি মুসলিমরা ঠিক হিসেবে দেখেন? তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কি মসজিদের মতো পবিত্র স্থানকে অবমাননা করা হয় না? এ ব্যাপারে সম্মানিত আলেম-ওলামারা কী ভাবছেন?

গত বছর দেখেছিলাম, কে যেন পতাকা বিছিয়ে নামাজ আদায় করেছেন। আর কই যায়, দেশপ্রাণ দেশপ্রেমিকরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন দেশের নষ্ট হয়ে যাওয়া মান-সম্মান ফিরিয়ে আনতে। নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি যেন খুন, ধর্ষণ, লুটপাটের মতো অতিশয় নোংরা কাজ করে ফেলেছেন। এর শাস্তি ভয়াবহ! আমাদের দেশে যখন এতো এতো অনুভূতিশীল মানুষজন অনুভূতির ব্যবসা করছেন তখন পশ্চিমারা দিব্যি পতাকার নকশায় তৈরি আন্ডারওয়ার পরে সৈকতে বসে রৌদ্র-স্নান করছেন। আমাদের দেশে পতাকাকে কেউ জায়নামাজ হিসেবে ব্যবহার করলে যদি অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় তাহলে তাদের দেশপ্রেমের অবস্থা কি সেটা চিন্তা করলেই তো সে দেশের সবার লজ্জায় মরে যাওয়া উচিত। দেশের গান গাওয়ার সময় বাঁ-হাত নাড়ালেই যদি অসম্মান হয় তো বাঁ-হাতের সম্মানটাও যে কোথায় যায়, তা নিয়েও একটা লেখা হতে পারে।

তো এসব মৌলবাদী চিন্তাকে অনেকে দেশপ্রেম ভেবে ভুল করেন। আসলে এগুলো কিন্তু দেশপ্রেমের অংশ নয়, হলেও সেকেন্ডারি লেভেলের দেশপ্রেম। দেশের পতাকা নিয়ে একটা ছবি তুলে এলাকার মোড়ে পোস্টার বানিয়ে রেখে, বাড়ির ছাদে সারি বেঁধে পতাকা ঝুলিয়ে রেখে দেশপ্রেমিক হওয়া সহজ। কিন্তু ভেতর থেকে দেশপ্রেমিক হওয়াটা কিন্তু বেশ কঠিন, যে কেউ চাইলেই এটা হতে পারে না। পতাকার জায়নামাজ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে যদি একটু দেশের কীসে ভালো হয় সেকথা ভাবতেন, তাহলে অন্তত দেশের মানুষ উপকৃত হতো, দেশও আপনাকে নিজের করে পেতো।

আপনার সবকিছুতে এতই যখন লজ্জা লাগে, শুধু দেশকে ছোট করতে লজ্জা লাগে না? লজ্জা লাগে না যখন হাতের টিস্যু, চিপসের প্যাকেট রাস্তায় ফেলে পাশেরজনকে বলেন ‘আরে এটা তো বাংলাদেশ, এখানে সব চলে!’ লজ্জা লাগে না যখন সারাদিনের সব উচ্ছিষ্ট জিনিসপত্র রাস্তায় ফেলে বর্ষাকাল এলেই সরকারের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধারে নামেন! একেবারেই লাগে না যখন আইন-কানুন আছে কি না কিচ্ছু না জেনে ‘এদেশে সবই সম্ভব, কোনো বিচার নেই’ বলেন তখন? কয়দিন দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছেন? কয়দিন নিজের অধিকারের জন্য গলা তুলে কথা বলেছেন, ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, জবাবদিহিতা চেয়েছেন?’

কথায় কথায় বলেন, এ দেশে মানুষের নিরাপত্তা নেই। আচ্ছা মানুষের নিরাপত্তা দেয়ার কথা প্রশাসনের সেটা মানলাম। কিন্তু আপনি যদি কাউকে খুন করতেই চান, প্রশাসনের কেউ আটকালে কি আপনি খুন করতে পারবেন না, চুরি করতে পারবেন না? আপনি খারাপ কাজ করতে চাইলে যেমন যে কোনোভাবেই করতে পারেন, ভালো কাজ করতে চাইলেও যেকোনোভাবেই করতে পারেন। আপনার ইচ্ছে থাকলে পৃথিবীর কোনো শক্তিই আপনার জন্য বাধা হতে পারবে না। আলাদাভাবে শুধু একটি প্রতিষ্ঠান বা একজন ব্যক্তি কখনো আপনাকে আমাকে নিরাপদে রাখতে পারবে না, দেশকে পরিচ্ছন্ন রাখতে পারবে না, দেশের খারাপ দিকগুলো রাতারাতি ভালো দিকে পরিণত করতে পারবে না। এর জন্য আপনাকে যেমন আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, আমারও আপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

এ দেশের শিক্ষিত মানুষগুলোকেও যখন দেখি কাগজের ঠোঙা আর বড় বড় পলিথিনের প্যাকেট রাস্তায় ছুড়ে মেরে, পানির বোতল গাড়ির বাইরে ফেলে দিয়ে দেশের ভালো-মন্দ নিয়ে বড় বড় কথা বলেন তখন আমার হাসি পায়। দেশের প্রতি করুণা হয়, এমন অধম-অশিক্ষিত, বিচার-বুদ্ধিহীন মানুষের জন্যই এতো সুন্দর একটা দেশের আজকে এই অবস্থা। এরা সবাই মনে করেন রাস্তা-ঘাট পরিষ্কারের জন্য সিটি কর্পোরেশনের ঝাড়ুদার আছে, সুতরাং রাস্তা নোংরা করার অধিকারও আমার, কার বাপের কী? এরা মনে করেন রাস্তায় চোর চুরি করছে তাকে ধরবার জন্য পুলিশ আছে, আমার সেখানে কি দায়িত্ব? এরা মনে করেন, পাশের বাড়িতে ভদ্রলোক কাজের মেয়ে বা বউ পেটাচ্ছেন তাদের শায়েস্তা করার জন্য আইন আছে। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কী দরকার?

এখন বলেন তো, কয়জন এসব দেশহিতৈষী কাজ করেছেন? কজনের জন্য দেশের একটু উপকার হয়েছে, দেশ একটু সুন্দর হয়েছে? আপনারা যে কথায় কথায় বলেন, ‘এটা বাংলাদেশ, এখানে ভালো কিছু করা সম্ভব নয়’ আপনারা বুকে হাত দিয়ে বলেন তো দেশের ভালোর জন্য আপনি কী করেছেন? দেশ কী আপনাকে, আমাকে বাদ দিয়ে ভিন্ন কোনোকিছু? নিজে কিচ্ছু না করে ‘এই দেশের কিছু’ হবে না টাইপ বক্তব্য দিয়ে আপনি যে দেশকে ছোট করলেন, সে অনুভূতি আপনার একেবারেই কি নেই? এতে দেশকে যে কতো বড় অপমান করা হলো, সেটা কি আপনি বোঝেন না?

ঘরে একটা কী-বোর্ড থাকলে পৃথিবীর সবকিছু করা সম্ভব রে ভাই, মাঠে নেমে কাজ করাটাই শুধু সম্ভব নয়। আইসক্রিম খেয়ে ডাস্টবিন খুঁজে না পেয়ে ৫ কি.মি পথ সেই প্যাকেট হাতে করে বয়ে বেড়ানো আর বাসায় বসে ‘দেশপ্রেম’ নিয়ে ১০০০ শব্দের রচনা লেখা এক কথা নয়। এই ছোট একটা কথা যেদিন থেকে এ জাতির কানে ঢুকবে, এ দেশের মানুষের মগজে প্রশ্ন করতে সক্ষম হবে, সেদিন থেকে মানে জাস্ট সেদিন থেকে দেশের উন্নয়ন আর ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। দেশপ্রেমিক তো অনেক হলেন, একটু সত্যি সত্যিই দেশকে ভালোবেসে দেখেন না কেমন লাগে! আসেন না, বিজয়ের মাসে তাই দেশকে ভালোবেসে, নিজের স্বার্থে সবাই যার যার জায়গা থেকে একটু দেশের জন্য ভাবি, ভালোবাসি! ভণ্ড দেশপ্রেমিক সেজে আর কতদিন?

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/এনএইচ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।