আমার আজকের আকাশের তারারা


প্রকাশিত: ০৫:৫৭ এএম, ৩০ নভেম্বর ২০১৬

ক্লাস নেয়ার জন্য আজ মেডিকেল কলেজে এসেছি। অফিসে ঢুকেই দেখি লিজ মুখ গোমড়া করে বসে আছে। ও মেডিকেল কলেজে প্রথমবর্ষে। আমি ওর মেন্টর বা পরামর্শদাতা। এখানে প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর একজন ‘মেন্টর’ আছে। সময়ে-অসময়ে, বিপদে-আপদে মেন্টর তাদের সাহায্য করে, বুদ্ধি বাতলে দেয়। লিজ একজন খুব বুদ্ধিমতী ও বড় হৃদয়ের মানুষ। ও বড় হয়েছে আটলান্টাতে। বাবাও একজন ডাক্তার। মেডিকেল কলেজে ঢোকার আগে ও তানজানিয়ার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে দরিদ্র মানুষের সেবা করেছে দীর্ঘ তিনটি মাস। বাংলাদেশ সম্পর্কে ওর ভীষণ কৌতূহল ৷ ওর ইচ্ছে ও এক-দু’মাসের জন্য বাংলাদেশে যাবে দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য ৷

লিজের মনটি খুবই খারাপ আজ। ওর এনাটমি ক্লাসের মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ শুরু হওয়ার পর থেকে মনটা ভালো যাচ্ছে না তার। এ দেশের মেডিকেল কলেজে ছাত্রছাত্রীদের শব ব্যবচ্ছেদের ক্লাসের জন্য যে দেহগুলো ব্যবহৃত হয়, তার সবই দানকৃত। অর্থাৎ একজন মহৎ মানুষ মানব সেবার জন্য দান করে গেছে তার দেহ। এখানে দেহ ব্যবচ্ছেদের আগে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে জানানো হয়- এই দেহটি কার, তার জীবন বৃত্তান্ত।

leg যে মানুষের দেহটি তাদের ক্লাস ব্যবচ্ছেদ করবে, তার জীবনটি বড় সংক্ষিপ্ত ছিল। মাত্র ২৩ বছর বয়সে একটি মারাত্মক রোগে সে চলে যাওয়ার আগে তার দেহটি দান করে দিয়ে যায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য। লিজের মন খুব খারাপ এজন্য। সময় নিয়ে তাকে বোঝালাম৷ আমাদের মনোবিজ্ঞানীর কাছে যেতে বললাম একটু আলাপ করার জন্য। যাওয়ার আগে লিজ ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেলো।

আজকের ক্লাস শেষ করে বাইরে বেরোলাম। লিজ আর প্রাণহীন এক মহাপ্রাণের কথা ভাবছি। আমার মেডিকেল কলেজে প্রথমবর্ষে পড়ার সময়কার কথাটা মনে পড়ে গেলো। আমাদের শব ব্যবচ্ছেদ ঘরের বাইরে একটা বড়ো বাক্সে ফরমালিনের মাঝে বেশ ক’টি মৃতদেহ সংরক্ষিত থাকতো। শুনেছি সে দেহগুলো কেউ কোনোদিন দাবি করেনি। আরেক কথায় ওগুলো সব ছিল ‘বেওয়ারিশ লাশ’। সেই বেওয়ারিশ দেহগুলো কাঁটাছেঁড়া করে ডাক্তার হয়ে গেলাম আমরা।

আমি কোনোদিন সেসব লাশের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের কথা এভাবে ভাবিনি। তারা কি জীবদ্দশাতে ভেবেছিল তাদের দেহের পরিণতি? তাদের নিকটজন কি ভেবেছিলো তা? ভাবতেই মনটা উথাল-পাথাল হয়ে গেলো। আমার মেডিকেল কলেজের চারদিকে কাশবন। বাতাসে এলোমেলো সেই কাশবনের মাঝে সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনটা বিষণ্ন হয়ে এলো। এ কাশবনটা উৎসর্গ করা হয়েছে অসামান্য কিছু মানুষের জন্য, যারা তাদের দেহ চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার জন্য দান করে গেছেন। অন্ধকার নামছে চারদিকে। তারা উঠছে আকাশে। আমার মেডিকেল কলেজের সেসব নাম না জানা বেওয়ারিশ মানুষগুলো আমার একেকটি তারা মনে হলো। আজ সন্ধ্যেবেলায় নতুনভাবে দেখলাম তাদের। দিনের আলোয় তারা দেখা যায় না।

লেখক : পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিভাগীয় প্রধান, ফ্লোরিডা হাসপাতাল, ফ্যাকাল্টি, কলেজ অব মেডিসিন, সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটি।

এইচআর/এনএইচ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।