চীনাদের গুণগুলো যদি পেতাম!


প্রকাশিত: ০৪:০৫ এএম, ৩০ নভেম্বর ২০১৬

চীনের কাছ থেকে বিস্তর সাহায্য-সহযোগিতা নিতে আগ্রহের সীমা নেই আমাদের। কিন্তু চীনের অভাবনীয় উন্নতির পেছনে লুকিয়ে আছে যে রহস্য বা রহস্যমালা সেগুলো নিয়ে কী ভাবছি আমরা? যতো সহজে নগদ সাহায্য পাওয়া যায়, চীনা জনগণের গুণগুলো তো ততো সহজে আসে না। হায়, প্রমথ চৌধুরী বড় খাঁটি কথা বলেছিলেন, ‘ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়।’ চীনাদের প্রথম গুণ তারা কথা কম বলে এবং কাজ বেশি করে। তাদের নেতারা মাঠে-ময়দানে কথার ফুলঝুরি বিছায় না। অসম্ভব-অবাস্তব প্রতিশ্রুতির বন্যা বহায় না। চীনের জাতীয় কংগ্রেস যেটি দুই অধিবেশন নামে পরিচিত সেখানে নেতারা সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা পেশ করেন এবং পরের অধিবেশনে হিসাব দাখিল করে দেখান কোন পরিকল্পনা কতদূর বাস্তবায়িত হয়েছে। তাদের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারিত সময়ের আগেই বাস্তবায়ন করতে পারে তারা। আর সেজন্য একেবারে শীর্ষ পর্যায়ের নেতা থেকে শ্রমিক পর্যন্ত সবাই কর্মতৎপর থাকেন।

চীন দেশে চাকরি করার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, চীনারা অসম্ভব পরিশ্রমী জাতি। ‘গ্রেট হল অব পিপল’ হলো ওদের পার্লামেন্ট ভবন এবং নয়া চীনের নতুন যাত্রার প্রতীক। এই গ্রেট হল অফ পিপল নামের বিশালাকার ভবনটির আকার-আকৃতির হিসাবটা আগে দেই। এটি লম্বায় ৩৫৬ মিটার এবং চওড়ায় ২০৬.৫ মিটার। ১ হাজার ৭১ হাজার ৮০০ বর্গমিটার ফ্লোর স্পেসবিশিষ্ট এই ভবনটির বড় ভোজন কক্ষে ১০ হাজার মানুষ একসঙ্গে বসে খাবার খেতে পারে। গ্রেট অডিটোরিয়ামেও ১০ হাজারের বেশি মানুষ একসঙ্গে বসতে পারে। গ্রেট অডিটোরিয়ামসহ প্রতিটি বিশাল কক্ষের সাজসজ্জা দেখলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। এইবার শুনুন আসল কথা। চীনের বিপ্লবের ১০ম বার্ষিকী উপলক্ষে স্থির করা হয় ১০টি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা তৈরি হবে। এই গ্রেট হল অফ পিপলও সেই ১০ স্থাপনার একটি। এইসব স্থাপনার প্রতিটি তৈরি হয়েছিল মাত্র ১০ মাস সময়ের মধ্যে। আর প্রতিটি তৈরি হয়েছিল স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। চীনের শ্রমিক শ্রেণি সিদ্ধান্ত দেয় এই ১০টি স্থাপনা তারা দেশকে উপহার দেবে। দিনে-রাতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তারা এক ঘণ্টার জন্যও কাজ বন্ধ করেনি। শিফট করে শ্রমিকেরা স্বেচ্ছায় এসেছে ও শ্রম দিয়েছে। ভাবা যায়?

বেইজিংয়ে আমি যেখানে থাকতাম সেই এলাকায় দেখেছি বিরাট বড় একটি ভবন তৈরি হয়ে গেলো তিন-চার মাস সময়ের মধ্যে। এবং হই-হট্টগোল ধুমধাম আওয়াজ, শ্রমিকদের হইহল্লা, কাজে ফাঁকি দেওয়া কিছুই নেই। সকাল ৭টায় কাজ শুরু হতো এবং ঠিক ৫টায় কাজ শেষ হতো। মাঝখানে এক ঘণ্টার লাঞ্চব্রেক। সব শ্রমিক ঠিক সময়ে কাজে আসছে, ঠিক সময়ে লাঞ্চ করে বিশ্রাম নিচ্ছে এবং ৫টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগপত্র গুটিয়ে বাড়ি রওনা হচ্ছে। এই শৃঙ্খলাবোধই তো আমরা অর্জন করতে পারিনি।

চীনাদের সময় নিষ্ঠাও পাশ্চাত্যের মানুষের মতোই। ঠিক ঘড়ির কাঁটায় এরা চলে। ‘বাঙালি টাইম’-এর ধারণাটি ওদের কাছে একেবারে অপরিচিত। চীনের যে কোনো অনুষ্ঠানে বা ডিনারে বা সভায় বা অফিসের দৈনন্দিন মিটিংয়ে সর্বত্রই দেখেছি, যে সময়ে শুরু হওয়ার কথা ঠিক সে সময়ই অনুষ্ঠানটি শুরু হচ্ছে। যদি চীনের প্রেসিডেন্টেরও ওই সময়ে আসার কথা থাকে তো তিনি ঠিক সে সময়ই হাজির হন। ৫ মিনিটও এদিক-ওদিক হয় না। ঢাকায় অনেক অনুষ্ঠানে, প্রেস কনফারেন্সে তো সঠিক সময়ে উদ্যোক্তারাই উপস্থিত হতে পারেন না। আমাদের কাছে ‘সময়ের মূল্য’ শুধু রচনার খাতায়। ছোটবেলায় স্কুলে ‘সময়ের মূল্য’ শিরোনামে রচনা লিখতে লিখতে ক্লাসের সময় পার হয়ে যেতো। সময়মতো দীর্ঘ রচনাটি শেষ করতে পারতো না কেউ। আমার ছোটবেলায় সময় অবশ্য ছিল অ্যানালগ। জানি না এখন ডিজিটাল যুগের শিশুরাও সময়ের মূল্য বিষয়ে রচনা লেখে কি না। রচনায় নয়, বাস্তব জীবনে সময়ের মূল্য আমরা যতদিন না বুঝতে শিখবো ততো দিন সাফল্য আমাদের কাছে অধরা হয়েই থাকবে।

চীনাদের বিপুল কর্মক্ষমতার একটি প্রধান কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে, তাদের স্বাস্থ্য-সচেতনতা। চীনারা নিজেদের খাবার সময়, বিশ্রামের সময়, ঘুমের সময়, ব্যায়ামের সময়ের সঙ্গে কোনো কম্প্রোমাইজ করে না। আরলি টু বেড অ্যান্ড আরলি টু রাইজ সত্যিই তাদের হেলদি ওয়েলদি অ্যান্ড ওয়াইজ করেছে। ওরা ভোর ৬টায় ওঠে, ব্রেকফাস্ট করে সকাল ৭টায়। লাঞ্চ করে ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে। লাঞ্চের পর ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম করে। ডিনার করে বিকেল ৫টায়। তারপর ইভনিং ওয়াকে বের হয়। রাত  ৯টার মধ্যে তারা ঘুমের দেশে পাড়ি দেয়। আমাদের মতো রাত ১১টা, ১২টায় খাবার খেয়ে ধুম করে ঘুমিয়ে পড়ে না। যে খাবারটা খেলো সেটা যেন শরীরের মধ্যপ্রদেশকে স্ফীত না করে পুরো শরীরের কাজে লাগে, ঠিকমতো হজম হয় সেদিকে ওদের পুরো খেয়াল।
তারা নিয়ম করে জিমে যায় বা থাইচি করে। শত বছরের সুস্থ্ জীবন চীনাদের জন্য বিরল কোনো ঘটনা নয়। ৭০-৮০ বছর বয়স পর্যন্ত তারা দিব্যি কর্মক্ষম থাকে। চীনের নারী-পুরুষ সবাই পরিশ্রমী এবং আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দৈহিক শক্তির অধিকারী। ওদের খাবারটাও খুব স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে রান্না করা হয়।  ওরা যখন পানি পান করে তখন তারা শুধু পানির বদলে ভেষজ শিকড়-মূল ভেজানো পানি খায়।

চীনারা দুর্নীতিবাজ নয়। সাধারণ জনগণ যথেষ্ট সৎ। অন্তত নিজ দেশের ভেতরে দুর্নীতি, অপরাধ ইত্যাদি করার কথা স্বপ্নেও ঠাঁই দেয় না ওরা। কারণ আইন বড়ই কঠোর। আইনের কাছে ছোট-বড় কেউ নেই। কোনো বড় নেতারও যদি দুর্নীতি ধরা পড়ে তো শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। চীনা নারীরা স্বাধীন। পথে-ঘাটে হয়রানি তো নেই-ই, পদে পদে ছোট ছোট নিষেধের ডোরেও তাদের বেঁধে রাখা হয়নি। তারা সবদিক থেকেই পুরুষের সমান বা বেশি কর্মক্ষম।

হ্যাঁ, চীনাদের গুণের শেষ নেই। তা আমাদের, মানে বাঙালিদেরও কি কোনো গুণ নেই? আমাদের একটা বিরাট গুণের কথা কিন্তু চীনারাও স্বীকার করে। বাঙালি খুব আবেগপ্রবণ। আমরা নয় মাসে দেশ স্বাধীন করা জাতি। বাঙালি যদি আবেগ দিয়ে কোনো কিছু করার কথা ভাবে, তাহলে কোনো বাধাই তার কাছে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। ল্যাটিন আমেরিকানদের চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে আমরা বেশি আবেগপ্রবণ। আমরা ভালোবাসতে জানি, বন্ধুত্ব করতে জানি। আমাদের কাছে অতিথি নারায়ণ। এগুলো প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালির মহৎ গুণ, বাঙালির বৈশিষ্ট্য। ফা হিয়েন, হিউয়েন সাং-এর মতো বিখ্যাত পর্যটকেরাও বাঙালির প্রশংসা করেছেন শতমুখে। বাঙালির আন্তরিকতা, অতিথি পরায়ণতা, ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব তুলনাহীন। আমাদের এই আবেগ আমাদের বড় সম্পদ। আবেগকে যদি ইতিবাচক পথে প্রবাহিত করা যায়, তাহলে আমরা অসাধ্য সাধন করতে পারি। আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে পেরেছি, দেশটাকে গড়তে কি পারবো না? দরকার শুধু বাঙালিকে সঠিক ধারার পথটা দেখানো।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/এনএইচ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।