অর্থ বাজারে অচল নোটে দুর্দশা


প্রকাশিত: ০৪:০১ এএম, ২৯ নভেম্বর ২০১৬

ভারতের অর্থ বাজারে সর্বোচ্চ দুটি নোটের মান ৫০০ এবং ১ হাজার রুপি। একটিমাত্র ঘোষণার ব্যবধানে সেই সর্বোচ্চ দুটি মানের নোট এখন শুধু কাগজ ছাড়া আর কিছুই না। ৫০০ এবং ১ হাজার রুপির নোট বাতিলের জন্য তিনটি বিষয় উল্লেখ করা হয়ঃ (ক) প্রচুর অবৈধ অর্থ বাজারে রয়েছে, যার বিপরীতে কোনো ট্যাক্স দেয়া হয় না। (খ) বড় মানের নোটের প্রচুর জাল নোট রয়েছে। এই জালনোট দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। (গ) সন্ত্রাসীদের কাছে প্রচুর বড় মানের রুপির নোট রয়েছে এবং তারা দেশের বিরুদ্ধে এই অর্থ দিয়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে আসছে।

তবে এই ঘোষণা আসার পেছনে নাকি একটা গল্প আছে। কয়েকটি গণমাধ্যমের ভাষ্য মতে, অনিল বোকিল নামের এক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কালো টাকা ঠেকাতে করণীয়বিষয়ক ৯ মিনিটের একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। এরপরই তিনি এই বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করার সুযোগ পান। সেখানে অনিল বাবু কালো টাকা প্রতিরোধে কয়েকটি বিষয়ে সুপারিশ করেছিলেন। (ক) ১ হাজার ও ৫০০ রুপির মতো বড় নোট অচল করে দিন, সম্ভব হলে ১০০ রুপির নোটও। (খ) সব লেনদেন ব্যাংক, চেক, ডিমান্ড ড্রাফটের মাধ্যমে বা অনলাইনে হওয়া উচিত। (গ) আমদানি ছাড়া বাকি ৫৬টি ক্ষেত্রে কর আদায় বন্ধ রাখুন। (ঘ) রেভিনিউ কালেকশনের জন্য সিঙ্গল ব্যাংকিং সিস্টেম রাখতে হবে।(ঙ) দেশের ৭৮ শতাংশ নাগরিক দৈনিক ২০ রুপি খরচ করে, তাদের কাছে বড় নোট থাকার সুযোগ নেই। (চ) ভারতে মোট লেনদেনের ২০ শতাংশ হয় ব্যাংকের মাধ্যমে এবং বাকি অংশ হয় নগদে, এই নগদের কোনো হিসাব নেই। প্রধানমন্ত্রীর বিষয়গুলো ভালো লাগার কারণেই ৫০০ এবং ১ হাজার রুপির নোট অচলের ঘোষণা এলো। মূল ঘটনা এটা কিনা, তা জানার অবশ্য সুযোগ নেই।
 
কালো টাকা রোধ করার জন্য অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত সরকার। কিন্তু যেসব সমস্যা এই সিদ্ধান্তের কারণে দেখা দিয়েছে, সে বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের জন্য জটিল আকার ধারণ করেছে। যদি কোনো ব্যক্তি ১০ হাজার কোটি রুপি কিংবা ২০ হাজার কোটি রুপি নগদ অর্থ সিন্দুকের মধ্যে রেখে দেয় কিংবা মাটির নিচে সংরক্ষণ করে রাখে, তবে নির্ঘাত সে ধরা খাবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি কেউ কাগজের নোট রাখে, তবেই সে সমস্যায় পড়বে। সরকারের উদ্দেশ্য শতভাগ সফল। ব্যাংকে টাকা জমা দিতে গেলে সমস্যায় পড়বে। টাকার উৎসের হিসাব দিতে হবে। সরকারের কাছে সব কালো টাকার তথ্যাদি চলে যাবে। কিন্তু সব কালো টাকা যে নগদ রূপে সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ আদৌ নেই।

কেউ যদি ৪০০ কেজি কিংবা ৫০০ কেজি সোনা সংরক্ষণ করে রাখে, তবে সরকারের কী করার আছে। কেউ যদি জমিতে কালো টাকা বিনিয়োগ করে, সেক্ষেত্রে সরকারের কী করার আছে। কেউ যদি লগ্নিতে রুপি খাটায়, সেসব ক্ষেত্রে প্রতিরোধের উপায় বিবেচনা করা হয়নি। এছাড়া অনেকের বিদেশে সেকেন্ড হোম কিংবা থার্ড হোমের ব্যবস্থা আছে। আর যারা বৈদেশিক বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত, তাদের কেউ যদি মিস-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করে থাকে, তবে সেই অর্থ কীভাবে অচল হবে। অনেক বড় কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি।

অথচ যে মানুষগুলো গ্রামে থাকে, যেখানে ব্যাংক নেই কিংবা যেসব নিরক্ষর ব্যক্তির কোনো ব্যাংক হিসাব নেই, টুকটাক ব্যবসা-বাণিজ্য করে দিন আনে দিন খায়, তারা তাদের কাছে মোট সঞ্চিত অর্থ সেটা ১০ হাজার কিংবা ১৫ হাজার রুপি হোক, কীভাবে লেনদেন করবে। সবার কাছেই ৫০০, ১ হাজার রুপির নোট। কেউ তো সেইসব নোট তাদের কাছ থেকে নেবে না। একটাই উপায় থাকে, কম মূল্যে দালালদের কাছে সেই অর্থ বিক্রি করে দেয়া। কষ্টের সঞ্চিত রুপি যদি দালালদের কাছে অল্প মূল্যে বিক্রি করতে হয়, তার চেয়ে দুঃখ আর কী হতে পারে।

ভারতের অর্থনীতি বিশ্বের প্রথম ১০টির একটি। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে ভারতের ব্যবসায়িক ব্যক্তিবর্গ। শক্তিশালী মুদ্রা ব্যবস্থার কারণে অনেকেই সরাসরি রুপিতে লেনদেন করে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশও লেনদেনের জন্য রুপি গ্রহণ করে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের সিদ্ধান্ত, রুপি লেনদেনকারীদের মাঝে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এরপর থেকে অনেকেই রুপিতে লেনদেন করতে চাইবে না। এর ফলে রুপির চাহিদা কমে যাবে, নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মুদ্রার বিনিময় হারের ওপর।

ভারতের নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও পড়েছে। যারা বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়ে টাকা বা ডলার ভারতীয় মুদ্রায় রূপান্তর করেছেন, তারা ব্যাপক সমস্যায় পড়েছেন। সেখানে অবস্থানরত চিকিৎসা সেবা প্রত্যাশী রোগীদের কষ্ট হচ্ছে। কেউ বড় নোটের রুপি গ্রহণ করতে চাইছেন না। অথচ মোট নোটের ৯৫ ভাগ বড় মানের নোট। ডাক্তারের ভিজিট দেয়া যাচ্ছে না, টেস্ট করানো যাচ্ছে না, ওষুধ কেনা যাচ্ছে না। অনেকেই বিনা চিকিৎসায় দেশে ফিরে এসেছেন। খাবারের হোটেলেও একই সমস্যা। ৫০ রুপি বিল হলে, খুচরা রুপিই দিতে হবে। ৫০০ রুপি ভাঙিয়ে কোনো খাবার হোটেল খাবার দেবে না। গাড়ি ভাড়া করে নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

মোটামুটি দুর্ভোগের একটা অকল্পনীয় অবস্থা তৈরি হয়েছে। একইসঙ্গে, আমাদের ব্যবসায়ীদের মোট ব্যবসায়ের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। ভারত থেকে পণ্য আমাদানি করার সময় প্রথমে বাংলাদেশি আমদানিকারককে রফতানিকারকের নামে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে পণ্যের বাজার মূল্যের সমপরিমাণ মার্কিন ডলার দিয়ে এলসি খুলতে হয়। ভারতের রপ্তানিকারকেরা পণ্য কিনে বাংলাদেশে পাঠান। পোর্ট থেকে পণ্য খালাসের সময় বাংলাদেশের আমদানিকারক ব্যাংক থেকে এনওসি দিলে রপ্তানিকারক সেখানের ব্যাংক থেকে এলসির টাকা তুলতে পারেন। কিন্তু এখন ভারতীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকে পর্যাপ্ত নোটের সরবারহ না থাকায় তারা এলসির পাওনা টাকা ওঠাতে পারছেন না। ফলে লোকসানের ভয়ে এলসি নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না সেখানের রপ্তানিকারকেরা। ভারতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও একই ধরনের সমস্যা বিদ্যমান। এদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে চলতি হিসাবধারী ব্যবসায়ীরা সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার রুপির বেশি ওঠাতে পারছেন না। ব্যবসায়ীদের এই অর্থে প্রয়োজন মিটবার কথা নয়।

২ হাজার রুপির নোট নাকি বাজারে আসবে। সে নোট যদি কখনও অচলের ঘোষণা আসে, তবে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের সূত্র মতে, ৫০০ এবং ১ হাজার রুপির নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে, ইতোমধ্যে ৫০-এর অধিক প্রাণহানি ঘটেছে। এদের মধ্যে অনেকেই আত্মহত্যা, দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির মানুষই এই অবস্থায় বেশি ভুক্তভোগী।

কালো টাকা উদ্ধার করা, জাল নোট জব্দ করা এবং সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ড বন্ধ করার জন্যই ৫০০ এবং ১ হাজার রুপির নোট নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। অবশ্যই মহৎ উদ্দেশ্য। অনেক কালো অর্থের ধারক যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তবে এই সিদ্ধান্তের ফলে কৃষক, ছোট ব্যবসায়ী, গৃহিণী, পর্যটক, রোগীসহ সাধারণ মানুষও অমানুষিক দুর্দশা ভোগ করছে।  ভারত দুই-চার কোটি মানুষের ছোট কোনো দেশ নয়। একটি-দুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে এতো বড় কাজের বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব, সেটা দেখার অপেক্ষায় বিশ্ববাসী।

লেখক : উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

এইচআর/এনএইচ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।