স্যার, আমাদের ক্ষমা করবেন


প্রকাশিত: ১১:৫২ এএম, ২৭ নভেম্বর ২০১৬

“মোবিন ইন্টার্নি শেষে লেখক হবেন নাকি চিকিৎসক? এইসব অসুখ, গল্প, কবিতা আর অপুষ্টি নিয়ে লেখা বাদ দেন। সমাজের অসঙ্গতি নিয়ে লেখেন। আমরা তো লেখতে পারি না। আপনারা যারা লেখালেখি করেন, তারা অন্যায়-অবিচার এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না জানালে, কারা রুখে দাঁড়াবে।”

কথাটা এখনো আমার কানে ভাসে। ২০১০ সালের কথা। আমি তখনো চিকিৎসক হইনি। মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের ইন্টার্নি ছিলাম (চিকিৎসক হবার জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম)। এই প্রশ্নটা যিনি আমাকে করেছিলেন, তিনি ভীষণ সৎ একজন চিকিৎসক। মরহুম ডাক্তার মুরাদ। যিনি ছিলেন আমাদের শিকদার মহিলা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের রেজিস্ট্রার। কাজের প্রতি ভীষণ নিবেদিত প্রাণ এক শিক্ষক ও চিকিৎসক ছিলেন তিনি। আমার থেকে মাত্র এক বছরের বড় ছিলেন তিনি। অথচ উনার ভয়ে আমরা সব সময় দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকতাম। এই বুঝি আমাদের বকা দিলেন, রোগীর ফাইলে কোনো ভুল পেলে আবারো হয়তো ফলোআপ লেখতে বলবেন।
সঠিক কাজের জন্য তিনি সব সময় উদগ্রীব থাকতেন। ভীষণ সুদর্শন, ঝামেলাবিহীন আর বিনয়ী এই মানুষটাকে আমরা কেউ ভুলতে পারি না, আর কোনো দিন ভুলবো না। তিনি আমাদের অনেকেরই অসংখ্য উপকার করেছেন ।

আমি অনুভবকে (আমার ছেলে) নিয়ে অনেক কষ্ট আর যুদ্ধ করে চিকিৎসক হয়েছি। ছোট্ট একটা শিশুকে রেখে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ডিউটি করতে গেছি। অনুভব যতবার অসুস্থ হয়েছে, মুরাদ স্যার আমাকে লেখাপড়া, ভালো ডিউটি শিডিউল দেয়ার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। আমাকে বার বার সাহস দিয়েছেন। শুধু আমি না, আমাদের অসংখ্য চিকিৎসক স্যারের কাছে ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ। এই ভালো মানুষটা আজ আর পৃথিবীতে নেই। যিনি আমাকে বলেছিলেন, সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লিখতে, সেই মানুষটার জন্য ভরে উঠেছিল সংবাদ মাধ্যম। মিডিয়া জগতে বয়ে গেছিলো ঝড়। এমন নিরীহ এক মানুষের এই পরিস্থিতি হবে, আমরা কোনো দিন ভাবিনি। অনেক মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকরা বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। কারা যেন স্যারকে মেরে পানিতে ফেলে দিয়েছিল। লাশ উদ্ধার হয়েছিল প্রায় তিনদিন পর। আমার প্রিয় বান্ধবী আইরিন কোন এক সকালে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জানালো এই হৃদয়বিদারক ঘটনা। মুহূর্তে ফোন করলাম, আমাদের সবার প্রিয় ড. জামান স্যারকে। উনার কাছেও মুরাদ স্যারের মৃত্যুর খবর শুনে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না।

স্যারের হত্যাকাণ্ডের পর অনেক মানববন্ধন, মিছিল হলো। ফেসবুকে ঝড় বয়ে গেল। পরিণামে ঘটলো সেই চিরচেনা ঘটনা। খুনিকে আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেল না। খুনের কোনো বিচার হলো না। বিচার চাই, বিচার চাই বলতে বলতে আর লিখতে লিখতে আমরা নীরব দর্শক হয়ে গেলাম। এক সময় সংবাদ মাধ্যমগুলো ভুলে গেল ডাক্তার মুরাদকে।

আমরা সবাই স্যারকে ভুলে গেছি। কিন্তু কীভাবে ভুলে থাকবেন স্যারের পরিবার? স্যারের সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল, উনি বাংলাদেশের মানুষ ছিলেন, যেখানে মৃত্যু খুব সাধারণ একটা ঘটনা। চা-কফি খাওয়ার মতো খুব সাধারণ কিছু।
Sir pls  pls  pls  forgive us.
আমরা আপনার খুনের বিচার করতে পারিনি। আমরা সাধারণ মানুষ, আমরা ভীষণ অসহায়। আমরা আপনাকে অকালে কবর দিতে পেরেছি। কিন্তু খুনিকে কঠিন শাস্তি দিতে পারিনি।
Sir  Please  forgive us.
আপনি পরপারে অনেক ভালো থাকেন। অনেক অনেক ভালো।

লেখক : চিকিৎসক।

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।