খাদিজার বেঁচে ওঠা ও আমাদের নতুন বোধ


প্রকাশিত: ০৪:১৮ এএম, ২০ নভেম্বর ২০১৬

চারদিকে ভালো খবরের খরা। কোথাও মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, কোথাও হিন্দুপাড়ায়  হামলা, কোথাও শত শত সাঁওতাল পরিবার আশ্রয়হীন। এর মধ্যে মন তাজা রেখে বাঁচা কষ্ট। তাই একটা করে এসব খবর পায় আর নিয়মিত মনে মরে যায় বহু মানুষ। আর অনেকেই ভাবেন আর বুঝি বাঁচা হলো না। খাদিজার সুস্থ হওয়ার খবরটি এই খরার মৌসুমে বৃষ্টির মতো।

এখন বলাই যায়, খাদিজার সঙ্গে সঙ্গে বেঁচে উঠলেন অনেকেই। কারণ তারা অপেক্ষা করছিলেন এই খবরটির জন্য। কাটলো তাদের দমবন্ধ অপেক্ষার প্রহর। খাদিজা এখন সুস্থ। এখন তিনি কথা বলতে পারছেন। নিজে খেতে পারছেন। অথচ অবাক ব্যাপার খাদিজাকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর থেকে দুই ধারায় ভাগ হয়ে গিয়েছিল আমাদের চিন্তিত সমাজ।

একদল বলেছিল আহা শেষ হয়ে গেলো মেয়েটা, এখন শুধু মৃত্যু ঘোষণার অপেক্ষা। এ নিয়ে গুজব ছড়াতে লাগলো একটা হতাশ গোষ্ঠী। তাদের চিন্তার ছাপ পড়েছিল কোনো কোনো গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে।
আরেক দল হাল ছাড়লো না । সর্বান্তকরণে চাইলো সুস্থ হয়ে যাক মেয়েটি। খোঁজ  নিয়ে দেখলাম শেষ দলে লোক বেশি।

কোনো এক প্রবীণের মুখে শুনেছিলাম বেশিরভাগ মানুষ যা চায় তাই হয়। খাদিজার ক্ষেত্রেও জয়ী হলো বেশিরভাগ মানুষের চাওয়া। যারা নেতিবাচক ভাবনা ভেবেছিলেন, এক্ষেত্রে তারা যে হারলেন, তা নয়। তবে তারা জয়ী ভাবনার অংশ হতে পারলেন না।

এখন আমরা বলতেই পারি, খাদিজার সুস্থ হয়ে ওঠায় চকচকে হয়ে উঠেছে একটি নতুন উপলব্ধি। ‘দিন শেষে শুভচিন্তা জয়ী হয়’ -এই উপলব্ধিটা ছিল খুবই কাঙ্ক্ষিত। কারণ আমাদের চারদিকে এখন যতো অশুভ, এর মধ্যে পড়ে শুভ শব্দটিই হারিয়ে যাচ্ছিল। শেষমেশ সবাই চেয়ে-চিন্তে একটা ভালো খবর অন্তত আনতে পারলো।

আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে এখন খারাপ ঘটনাগুলোই স্বাভাবিক। তাই খাদিজার সুস্থ হওয়ার পথ ধরে আমাদের আরো নতুন বোধ সৃষ্টি হওয়া দরকার। যেমন, যে কোনো ‘ভালো’ আসলে আমাদের সবাই মিলে চাইতে হবে। ‘চাইতে হবে’ -শব্দ দুটির ওপর বেশি জোর দিচ্ছি, কারণ ইদানীং যে কোনো খারাপ ঘটনার পর আমরা খুব বেশি দুঃখ পাচ্ছি, হতাশ হচ্ছি। বড়জোর ফেসবুকের একটা বিদগ্ধ স্ট্যাটাসের জাল পাতছি। আর কিছুক্ষণ পর পর জাল উঁচু করে দেখছি, কয়টা লাইক আর কয়টা কমেন্টেস পড়লো। দেখছি কতটা শেয়ার হলো।  

এতে কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। শুধু হতাশার বোঝা ভারি হচ্ছে। আর নিরাপদে খারাপ ঘটনাগুলো ঘটতে পারছে। কিন্তু হতাশ না হয়ে যদি, একটি খারাপ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা আরেকটি খারাপের মুখোমুখি হতাম, তাহলে সেই খারাপের প্রভাব ছোট হয়ে যেতো। এক সময় আমরা সব খারাপকে তাড়িয়ে দিতে পারতাম হয়তো। দিন শেষে দেশটা তো আমাদের। আমরাই তো থাকবো এখানে।  

আমরা একবারও ভাবছি না, কোনো ভালো চাইতে হলে সবার আগে সেই চাওয়ার পেছনে সর্বোচ্চ ইচ্ছেটা বিনিয়োগ করা দরকার। এর পরই তো লড়তে হবে অশুভ শক্তির সঙ্গে। কারণ যে কোনো সৃষ্টির জন্য লড়াই লাগবেই। আর লড়াইয়ের প্রথম অস্ত্রই হচ্ছে ইচ্ছেশক্তি।

ধরা যাক, কোনো একটি বিপদ এলো। এর শুরুতেই যদি কেউ ভেবে নেয়, এই বিপদের পাহাড় সে ডিঙাতে পারবে না। তাহলে তাকে দিয়ে আলোচনার টেবিল গরম করা ছাড়া আর কিছুই হবে না। সেজন্য খাদিজা আহত হওয়ার পর যারা নিশ্চিত করে বলেছিলেন, ‘এই মেয়ে বাঁচবে না’, তাদের অভিসম্পাত করছি। কারণ এরা ভীতু এবং পশ্চাৎপদ। এরা নিজেরা তো লড়তে পারেই না, উল্টো অন্য কোনো এক যোদ্ধাকে টেনে ধরে পেছন থেকে। এই মানসিকতার লোকজন যে কোনো প্রগতির বোঝা।

লাল সালাম জানাই খাদিজার পরিবারের সদস্যদের। যারা মেয়েটিকে বাঁচানোর যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। আর পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর জন্য সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সেই ছেলেটি পর্যন্ত, যিনি মোবাইলে সেই ভয়াবহ ছবিটি তুলেছিলেন। ধরা যাক, জখমের পরিমাণ দেখে আর হতাশাবাদীদের বক্তব্য শুনে যদি খাদিজার পরিবার যুদ্ধ থামিয়ে দিতো, পাঠক- আপনারা কী একবার ভাবতে পারেন, কী হতো?

আমি সেটা ভাবতেও পারি না। এমন কী, ভাবতে চাইও না। কারণ আমি মনে করি, চিরতরে শ্বাস বন্ধের আগের শ্বাসটিও নেয়া উচিত শান্তিতে। কাজ করতে হলে সজীব থাকা দরকার সারাক্ষণ। পরিস্থিতি যতো প্রতিকূলই হোক, হতাশ হলেই তিনি হারু পার্টি। কোনো প্রগতিশীল মানুষের হারতে চাওয়া উচিত না। সবসময় জয়ী হওয়া উচিত খাদিজার পরিবারের মতো।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।
[email protected]

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।