সুপার মুন বনাম সাঁওতাল পূর্ণিমা


প্রকাশিত: ০৩:৫৯ এএম, ১৭ নভেম্বর ২০১৬

সুপার মুন দেখা দিয়েছিল আকাশে। বিশ্ববাসীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের মানুষও চাঁদ দেখতে মশগুল হয়ে গিয়েছিল। যতটা না চাঁদের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে, তারচেয়ে বেশি ফেসবুকে ছবি পোস্ট করার আগ্রহে। আমরা চাঁদ দেখছি। গান শুনছি। এসব করে সময়-টময় পেলে নিজেকে সামাজিক ইস্যুতে সচেতন প্রমাণ করার জন্য কখনও নাসিরনগরের মন্দির ভাঙচুর  আর সাহেবগঞ্জের সাঁওতালদের নিয়ে লিখছি, পোস্ট দিচ্ছি। দারুণ! কতো সচেতন হয়েছি আমরা! কতো উন্নত!

আর সাহেবগঞ্জের গৃহহারা সাঁওতালরা কীভাবে চাঁদ দেখেছে? উত্তরবঙ্গের তীব্র শীতের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে চাঁদের দেহ থেকে ঝরে পড়া হিম তাদের অভুক্ত দেহের ওপর কীভাবে পড়েছে? শিশু, বৃদ্ধদের নিয়ে তারা কি পূর্ণিমা উদযাপন করেছেন নিরন্ন থেকে, গৃহহীন থেকে? পূর্ণিমার চাঁদ কি তাদের কাছে ঝলসানো রুটি বলে মনে হয়েছে?

সাঁওতালদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান আমলে তাদের বাপদাদার জমি লিজ দেওয়া হয়েছে চিনিকলকে। আর আজ স্বাধীন বাংলাদেশে সেই পাকিস্তান আমলের চুক্তির নজির তুলে ধরে নিজ গৃহ থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকদের।
চোখের সামনে তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার পর, তাদের এখন ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। কাজে যাওয়ার অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়েছে এই মানুষদের। নিরুপায় সাঁওতালরা বলেছেন, তারা ভারতে চলে যাবেন। কতো দুঃখে, কতো বঞ্চনায় তারা নিজের দেশ ত্যাগ করে চলে যেতে চাচ্ছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আর্য ও সেমেটিকদের আগমনের আগে এই অনার্য, সাঁওতাল, কোল, মুন্ডা, দলিতরাই ছিলেন এ দেশের আদিম অধিবাসী। এরা সরল। এরা ভূমিপুত্র-কন্যা। আবহমানকাল থেকে তারা এই ভূখণ্ডে বসবাস করছেন। তাদের জমির দলিল নেই তার মানে এই নয় যে, এই জমি তাদের নয়। আবহমানকাল থেকে যে আদিবাসী সাঁওতালরা এই ভূমিতে বাস করছেন, সুতরাং যে কোনো সহজ বুদ্ধি এবং মানবিক বিচেনায় একথা স্পষ্ট যে ওই ভূমি তাদেরই।

সাঁওতালরা চিরদিনই সাহসী জাতি। তারা একসময় ব্রিটিশের জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বন্দুক-পিস্তলের মোকাবেলায় সামান্য তীর-ধনুক নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এই সাহসের বলেই তারা সরকারি ত্রাণ নিতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। বাঙালি ছেলেমেয়েরা যখন স্কুলে ‘বেগ মোস্ট রেসপেক্টফুলি’ বা ‘অধীনের আকুল আবেদন’ বলে ভিক্ষার দরখাস্ত লেখার শিক্ষা নিচ্ছে তখন নিরন্ন-আশ্রয়হীন সাঁওতালরা ক্ষোভের সঙ্গে সরকারের দেয়া ত্রাণকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাদের এই প্রত্যাখ্যানের সামনে সত্যিই শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে।  তারা ভিক্ষা চান না। তারা তাদের বাপদাদার জমি ফেরত চান। তারা তাদের ন্যায্য অধিকার চান। তাদের এই অধিকার কি তারা ফিরে পাবেন না?

মাদল বাজছে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। আজ উৎসব। আদিম গ্রাম সেজেছে পাতা আর  ফুলে। ফুলে ফুলে ভরা ছাতিম গাছ। ভেসে আসছে তীব্র সৌরভ। শিকার থেকে ফিরছেন সাঁওতালরা। এখনই শুরু হবে পূর্ণিমা রাতের উৎসব। সাঁওতাল নারী-পুরুষেরা ধীরে ধীরে জমায়েত হচ্ছে গ্রামের মাঝে এক খোলা প্রাঙ্গণে। একপাশে খোলা আগুনে ঝলসানো হচ্ছে সজারু আর হরিণের মাংস। মাদল বাজছে। শুরু হচ্ছে গান ও নাচের আসর। এই গ্রামের মাটির তৈরি পাতায় ছাওয়া কুটিরে সুখের অভাব নেই। স্বাস্থ্যবান নারী-পুরুষ, প্রাণচঞ্চল শিশু। বৃদ্ধদের চেহারায় প্রশান্তির ছাপ।

হ্যাঁ, হাজার হাজার বছর আগে এমনি ছিল এই অঞ্চলের আদিম অধিবাসীদের জীবনযাত্রা। শিকার ও সংগ্রহ অর্থনীতির সেই যুগে জমির কোনো দলিল ছিল না। তখন পরচা, স্ট্যাম্প, দাগ নম্বর ইত্যাদির প্রয়োজন হতো না। সব গোত্রই জানতো কোনটা কোন গোত্রের অধিকৃত ভূমি।  অস্ট্রালয়েড গোষ্ঠীর এই মানবেরা তখনও পদানত হয়নি আর্য, তুর্কি, আরবদের কাছে। এই আদিম জনগোষ্ঠীই আমাদের পূর্বপুরুষ। আজ যাদের অবজ্ঞা করে দূরে সরিয়ে রেখেছি আমরা। এই সরল মানুষেরা এখনও বোঝে না ভূমি রেজিস্ট্রি, দলিল, মৌজা আর খতিয়ান নম্বরের মারপ্যাঁচ। আর বোঝে না বলেই তাদের জমি অন্যদের কাছ থেকে লিজ নিয়ে সেখানে গড়ে ওঠে চিনিকল। বোঝে না বলেই তাদের ভূমি হয়ে যায় চিনিকলের জমি। বোঝে না বলেই এই দরিদ্র মানুষদের কাছ থেকেও টাকা ওঠায় প্রতারক চক্র, এই আশ্বাসে যে তাদের বাপদাদার জমি তাদের ফিরিয়ে দেয়া হবে। সরল মানুষগুলো প্রতারকদের হাতে তুলে দেয় তাদের শেষ সম্বল। তারপর চোখের সামনে দেখে দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে তাদের ছোট্ট কুটির। শিশুদের চোখের সামনে পুড়ে যায় তাদের স্কুল। পুড়ে যায় একটু মাথা গুঁজে থাকার ঠাঁই, একটু একটু করে গড়ে তোলা গৃহস্থালি।

খোলা আকাশের নিচে বসে থাকে তারা। আর ঢাকা নগরের অধিবাসীরা আকাশে সুপার মুন দেখে। দেখে আপ্লুত হয়। স্ট্যাটাস দেয়, ছবি দেয় ফেসবুকে। সুপারমুন ফিরে আসবে আবার ষাট দশক পর। কিন্তু সাঁওতাল পূর্ণিমা কি আর কখনও ফিরে আসবে? আর কি বাজবে সেই পুরনো মাদলের ধ্বনি? সাড়া জাগাবে রক্তের ভেতর। আর কি কখনও সেই মুক্ত-স্বাধীন জীবন ফিরে পাবে আমার সাঁওতাল ভাইবোনেরা? নিজের ভূমিতে আর কখনও কি হাসি-আনন্দে মেতে উঠতে পারবে ভূমিপুত্র-কন্যারা?

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।