সিডর একটি বিভীষিকাময় রাত প্রত্যক্ষদর্শী আমি


প্রকাশিত: ১২:২৪ পিএম, ১৬ নভেম্বর ২০১৬

কদিন বাদেই ফাইনাল পরীক্ষা। প্রস্তুতি পুরোদমে। নোটপত্র রেডি করে পড়ার টেবিলে বসে পড়লাম। বিকেল থেকেই কালো মেঘ আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। সন্ধ্যা তখন সাড়ে ৭টা। নিস্তব্ধ হয়ে যায় চারদিক। শোঁ শোঁ বাতাস আর গুড়মুড় শব্দে ধ্বংস লীলায় পরিণত হয় চারদিক।

বলছিলাম ২০০৭ সালের ১৪ নভেম্বরের সেই ভয়াল রাতের কথা।

বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জ থানার সন্ন্যাসী গ্রামে আমার বাড়ি। সুন্দরবন, নদী-নালা, খাল-বিল এই নিয়ে বন্যাপ্রবণ এলাকার মানুষ আমি। বন্যার সঙ্গে লড়াই করে বাচঁতে হয় আমাদের। কখনো ভারি বৃষ্টি, কখনো জলোচ্ছ্বাস। আবার কখনো বা ভয়াবহ দুর্যোগে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সবকিছু। কিন্তু সবকিছুই হার মানিয়েছিল সেই ভয়াল রাত। যার নাম ‘সিডর’।

সেদিন বাবা বাসায় ছিলেন না। কোনো এক কাজে আমাদের পাশের থানা শরণখোলায় গিয়েছিলেন। বাড়িতে মা, আমি আর ছোট ভাই-বোন। বিকেল থেকেই টিভিতে মহাবিপদ সংকেত অর্থাৎ ১০ নম্বর সংকেত দিয়েছিল। তারপরও আমরা সাইক্লোন শেল্টারে যাইনি। আমাদের গ্রাম থেকে সাইক্লোন শেল্টার অনেক দূরে। তাই মা বলছিল, কোথাও যাওয়ার দরকার নাই। আল্লাহ আমাদের পাশে আছে। কিছুই হবে না।

সন্ধ্যার পরই বিদুৎ চলে গিয়েছিল। চারদিকে প্রচণ্ড বেগে বাতাস আর বৃষ্টি। তখন সাড়ে ৭টা বাজে। শুরু হল মহাতাণ্ডব। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর গাছপালা, ঘর-বাড়ি ভেঙে পড়ার শব্দ। পাশাপাশি মানুষের আর্তচিৎকার ‘বাঁচাও বাঁচাও’। যদিও পানি দেখতে পাইনি। কারণ, আমাদের ঘর ছিল বাঁধের মধ্যে।

আমি আর আমার ছোট ভাই-বোন মায়ের চারদিকে জড়সড় হয়ে বসে থাকলাম। বিকট শব্দে একটি গাছ আমাদের ঘরের ওপর এসে পড়ল। তখন সবাই মিলে চিৎকার দিতে থাকি। কিন্তু কেউ শুনে না আমাদের চিৎকার। মা দোয়া পড়তে থাকে। ছোট ভাই-বোনের কান্নাকাটি যেন থামেই না। আমি ভেবেছিলাম এটাই হয়তো আমাদের শেষ দিন। আমাদের জড়িয়ে ধরে মা বলতে লাগল, বাবা আমরা হয়তো কেউই বাঁচব না। এই মুহূর্তে তোর বাবাকে দেখে যেতে পারলাম না। জানি না তিনি কি অবস্থায় আছেন।

এদিকে আমাদের ঘর হেলে পড়ে। ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির পানিতে সবাই ভিজে গিয়েছিলাম। গায়ে কাঁথা দিয়েও সবাই শীতে কাঁপতে ছিলাম। যখন রাত সাড়ে ১২টা,  ঝড়ের গতিবেগ অনেকটা কমতে থাকল। শান্ত হয়ে আসল চারদিক। কিন্তু মানুষের চিৎকার আর আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছিল পুরো এলাকা। চারদিকে শুধু কান্না আর বাঁচাও বাঁচাও শব্দ।

চোখে ঘুম নেই। বেড়িয়ে পড়লাম বািইরে। হঠাৎ চিৎকার আর কাঁদতে কাঁদতে বাবা চলে এলেন। সবাইকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। সবাই মিলে একসঙ্গে চিৎকার আর কাঁদতে লাগলাম। এর মধ্যে সকাল গড়িয়ে এলো।

সকাল হতেই অন্য এক চিত্র ভেসে উঠলো আমাদের চোখের সামনে। চারদিক যেন একাকার। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল কান্নার রোল। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি আর মানুষের লাশ। গোটা এলাকা পরিণত হয় এক ধ্বংসস্তূপে। খাবার আর পরিধানের এক টুকরা কাপড়ের সন্ধানে অসহায় মানুষ ছুটছে এখানে সেখানে। আমাদের ঘরেও ছিল না কোনো খাবার। ঘরে যা ছিল সব নষ্ট হয়ে গেছে।

ছোট ভাই-বোন নিয়ে না খেয়েই কাটল সেদিন। কিছুদিন পর পরীক্ষা, তাই গেলাম বইয়ের সন্ধানে। তবে কোনো বই-খাতা কিংবা নোট খুঁজে পেলাম না। অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকলাম। এই ধ্বংসলীলা কোনো দিনও ভুলব না। আজও সেই দিনটির কথা মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে। সিডর শব্দটি কানে আসলেই চোখে ভেসে ওঠে এক বিভীষিকাময় রাতের কাহিনী। এক ধ্বংসলীলা আর একটি অচেনা সকাল।

লেখক : সাংবাদিক
[email protected]

এমএএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।