ট্রাম্প ও বাংলাদেশ


প্রকাশিত: ০৪:২৬ এএম, ১২ নভেম্বর ২০১৬

নির্বাচন-পরবর্তী বক্তব্যে দুঃখ আর হতাশা গোপন রাখেননি হেরে যাওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারি ক্লিনটন। তবে তার ক্ষমতায় আসা নিয়ে এই দেশে যারা উচ্ছ্বসিত ছিলেন তারা অনেকটাই চুপসে গেছেন। বিএনপি’র একজন নেতা নির্বাচনের আগে হিলারির সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার ছবি পোস্ট করে বলেছিলেন ২০১৭-তে এমন ছবি আবার দেখা যাবে। তার অর্থ হলো- হিলারি বিএনপি-জামায়াতের ক্ষমতায় আসার পথ প্রশস্ত করবেন। হিসাবটা উল্টে যাওয়ার পরপরই সেই পোস্ট আর দেখা যাচ্ছে না।

বিএনপি-সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা হিসাবটা করেছিলেন আরো গতিশীলতার সঙ্গে। যেহেতু বর্তমান হাসিনা সরকারের সঙ্গে নোবেল পাওয়া অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূসের সম্পর্ক বৈরিতাপূর্ণ, আবার হিলারির সঙ্গে তার গভীর বন্ধুত্ব তাই বিপদে পড়বেন শেখ হাসিনা আর এই বিষয়টাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় আসবে বিএনপি। এমন একটা উচ্চাশা ভারতের নির্বাচনের সময়ও দেখিয়েছিল বিএনপি ও তার সমর্থকেরা। নরেন্দ্র মোদির বিজেপি কংগ্রসকে হারাবে- এমন আভাস পেয়েই আগাম অভিনন্দন জানানো, বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের সঙ্গে বেগম জিয়ার হাস্যকর ফোনালাপ কেলেঙ্কারি এখনো রাজনৈতিক অঙ্গনে সরব আলোচনা।

‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’-এই স্লোগানের ওপর ভরসা রাখলো মার্কিন নাগরিক। ৪৫তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ৭০ বছরের এই ধনকুবেরের হাত ধরে আট বছর পরে ক্ষমতায় ফিরলো রিপাবলিকান পার্টি। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অধিকাংশ জরিপকে ভুল প্রমাণ করেছেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের জয়ে উদ্বেগে বাংলাদেশিসহ নানা দেশের মার্কিন অভিবাসীরা। অনেকেই বলছে, শুরু হলো আমেরিকার এক অনিশ্চিত পথচলা। কিন্তু আসলেই কি তাই? অপেক্ষা করতে হবে আমাদের, দেখতে হলে এই অপেক্ষায় থাকতে হবে জানুয়ারি পর্যন্ত।

বিশ্বজুড়ে ছিল হিলারিবন্দনা। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে টানটান উত্তেজনায় থরথর করে কেঁপেছে গোটা বিশ্ব। কারণ, ট্রাম্প জানিয়ে দিয়েছেন আউটসোর্সিংয়ে রাশ টানবেন। দেশের ছেলেমেয়েদের চাকরিচ্যুতি আর হতে দেবেন না। নিউইয়র্ক টাইমস থেকে শুরু করে রয়টার্স, সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবীরা বলেছেন, পাগলের প্রলাপ! কিন্তু আসলে কেউ বুঝতেই পারেননি, গোটা দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষ ও শিক্ষিত বেকারেরা তাকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। ফ্লোরিডা, পেনসিলভেনিয়া, ওহাইয়ো, আইওয়া- এই চারটে স্টেটই আগে ওবামার দখলে ছিল। এবার সব ক’টিই ট্রাম্প ছিনিয়ে নিয়েছেন। ওই স্টেটগুলোতে ৭৩টি ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট ছিল। আর এটাই কার্যত ট্রাম্পের জয়ে ঝড় তুলে দিলো বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিন ট্রাম্প বার বার বলেছিলেন, তিনি রাজনৈতিক নেতা নন। তার মতো ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার সুযোগ বার বার আসবে না। সেই সুযোগটাই নিলেন মার্কিন জনতা। বিশ্বব্যাপী মার্কিননীতির প্রভাব সর্বজনবিদিত। দেশটির ক্ষমতার পালাবদলে পররাষ্ট্রনীতিতে কি পরিবর্তন আসবে, ট্রাম্পের নেতৃত্বে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হবে, এটা এক বড় প্রশ্ন। তবে অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে রাতারাতি বড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। তাই এখনই বলা যাচ্ছে না কোন পথে হাঁটবেন ট্রাম্প। প্রতিযোগী ট্রাম্প আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক থাকবেন না বলেই ধারণা বেশি।

বাংলাদেশ প্রশ্নে ঠিক কী ধরনের নীতি ট্রাম্পের থাকবে- তা এ মুহূর্তে পরিষ্কার নয়। নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলিম ও অভিবাসীবিরোধী নানা বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী মুসলিম, কৃষ্ণাঙ্গ ও মেক্সিকানসহ অভিবাসী জনগোষ্ঠী স্বভাবতই উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত ১০ লাখ বাংলাদেশি বৈধ বা অবৈধভাবে বসবাস করেন। তারাও যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। মুসলিম দেশ হিসেবে ট্রাম্পের মুসলিমবিরোধী মনোভাবের ছোঁয়া বাংলাদেশও পাবে কিনা- তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এটি নির্ভর করবে নতুন প্রেসিডেন্টের বিদেশবিষয়ক নীতিনির্ধারকেরা কী ধরনের পরামর্শ তাকে দিচ্ছেন এবং তিনি তা কতটা মেনে চলছেন।

তবে নির্বাচনী প্রচারের সময় যে ট্রাম্পকে দেখা গেছে বিজয়ী ভাষণে এক অন্যরকম ট্রাম্পকে দেখলো সবাই। ট্রাম্প মার্কিন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে যিনি সমানে অনাস্থা দেখিয়ে গেছেন- বলেছিলেন, না জিতলে ভোটের ফল গ্রাহ্যই করবেন না, সেই ট্রাম্পই আবার বলেছেন, ‘বিভেদের ক্ষতে প্রলেপ লাগিয়ে আমেরিকাকে এবার ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এ দেশের সবাইকে বলছি, আমি আপনাদের সবার প্রেসিডেন্ট হবো। সবাই মিলে আমেরিকাকে এক সুতোয় বাঁধব। সত্যি হবে দ্য আমেরিকান ড্রিম।’   

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যে লড়াই, তা কোন দিকে মোড় নেয় দেখার বিষয়। বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী সাম্প্রতিককালে যেসব ঘটনা ঘটিয়েছে সেসব ক্ষেত্রে ওবামা প্রশাসন যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসনের মনোভাব ভিন্ন হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। সিরিয়া এবং ইরাকে ইসলামি খেলাফত গোষ্ঠী-তথা আইএস প্রশ্নে ট্রাম্প আরো কঠোর হলে তার একটা প্রভাব আসবে বাংলাদেশের দিকেও।

হিলারি নিজে এবং ডেমোক্র্যাটরা প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে আইএসকে সহযোগিতা করেছে। ট্রাম্প আইএস নির্মূলের কথা বলেছেন। রাশিয়ার সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক থাকায় আইএস প্রশ্নে মার্কিন নীতি নতুন মোড় নেবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। পাকিস্তানের অনেক বিশ্লেষক বলছেন, জঙ্গি ও জিহাদিদের ছাড়  দেবেন না ট্রাম্প, তাই পাকিস্তানে থাকা জঙ্গি গোষ্ঠীর জন্য স্বস্তি নয় ট্রাম্পের জেতা। একইভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে যেসব জঙ্গি গ্রুপ আছে এবং জামায়াত-হেফাজতের মতো তার সমর্থক গোষ্ঠী আছে, তারাও নিশ্চয়ই নতুন করে হিসাব-নিকেশ করবে আমেরিকার এই পরিবর্তনকে।  

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের সুসম্পর্ক থাকায় বিশ্বশান্তির ক্ষেত্রে এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে অপর বৃহৎ শক্তি চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কী হবে- তা স্পষ্ট নয়। গত জানুয়ারিতে নিউইয়র্ক টাইমসকে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি চীনা পণ্যের ওপর ৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের পক্ষপাতী।

এ বক্তব্যের মাঝে বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধের ঝুঁকি রয়েছে। তবে এরই মধ্যে বড় মার্কিন কর্পোরেট হাউসগুলো বলতে শুরু করেছে, নির্বাচনের সময় যতই ট্রাম্প প্রটেকশনিজমের কথা বলেন না কেন, বাস্তবতা হলো তাকে এক্সপানশনিজমের দিকেই যেতে হবে, কারণ আমেরিকার অর্থনীতি বরাবরই বিকশিত হয়েছে পৃথিবীর অর্থনীতিকে সঙ্গে নিয়ে। যদি তা হয় তবে বাংলাদেশের জন্যও ইতিবাচক যদিও জিএসপি প্রশ্নে হয়তো খুব তাড়াতাড়ি কোনো সিদ্ধান্ত আসবে না, যা আশা করছেন এখানকার ব্যবসায়ী সমাজ।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।