নীরবতাই হোক নারীর নতুন লজ্জা

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:৫২ এএম, ০৯ নভেম্বর ২০১৬

একবার এক কদমফোটা বর্ষণমুখর দুপুরে এক রিকশাওয়ালাকে জুতাপেটা করেছিলাম আমি। শুনে কী মনে হচ্ছে আমি এক দাম্ভিক মধ্যবিত্ত নারী, যে সামান্য কোনো অপরাধে সহজেই হাত তুলে ফেলেছিল দরিদ্র, নিরীহ, দুর্বল এক রিকশাচালকের গায়ে?

এখানেই আপনাদের ভুল, আপনারা কী করে ভাবেন আমাদের সমাজে একজন নারীর স্থান সাধারণভাবে একজন পুরুষের উপরে হতে পারে? হোক না সেই নারী একজন শিক্ষিত চাকরিজীবী আর সেই পুরুষ একজন সাধারণ অর্ধ-উলঙ্গ রিকশাচালক? অপরাধ আমার হয়েছিল বটে, তবে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারের অপরাধ নয়, বরং নির্যাতকের প্রতি নির্যাতিতের দম্ভের অপরাধ।

পুরুষ প্রভু, পুরুষ ক্ষমতাবান, পুরুষ সক্ষম। যে কোনো শ্রেণির একজন পুরুষ যে কোনো শ্রেণির একজন নারীর সঙ্গে সময় ও সুযোগে যা ইচ্ছা তা করার অধিকার রাখে, কারণ সে জানে এই সমাজটা তার হাতে, তারই সুবিধার্থে গড়া।

সেদিনের সেই রিকশাচালকও নিশ্চয়ই তাই ভেবেছিল। আমার সাত বছরের ছেলেকে নিয়ে গেছি দাঁতের ডাক্তারের কাছে। চিকিৎসা গ্রহণ শেষে বাইরে বেরিয়ে ভীষণ বিপদে পড়লাম। সিলেটের আষাঢ়ে বৃষ্টি আকাশ উপুড় করে ঝরছে, প্রচণ্ড বৃষ্টিতে আর বজ্রপাতের শব্দে নিজের কণ্ঠস্বরই শোনা দায়। ভাগ্যক্রমে একটা রিকশা পেয়ে গেলাম। লোকটা ভাড়া নিয়েও দরাদরি করলো না দেখে মনটা খুশি হয়ে গেলো, সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করলাম ভাড়াটা বাড়িয়েই দেব।

আমরা রিকশায় উঠে বসার পর সে তার পলিথিনটা এগিয়ে দিলে আমি হাত বাড়িয়ে নিতে গেলাম কিন্তু আমার হাতে পলিথিন না দিয়ে সে নিজেই গুঁজে দিতে শুরু করলো, আমি প্রতিবাদ করার আগেই সে তার ডান হাতে চেপে ধরল আমার বাম স্তন। এতোটাই জোরে যে এটাকে নিতান্তই একটা দুর্ঘটনা বলে ভাবার কোনো সুযোগই ছিল না।

আমি লাফ দিয়ে নামলাম রিকশা থেকে, নামলো আমার সাত বছরের ছেলেও। আমি ভুলে গেলাম প্রচণ্ড বৃষ্টির কথা, আমি ভুলে গেলাম আমার শিশু ছেলে দেখছে, আমি ভুলে গেলাম গরিব খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি আমার প্রচণ্ড মমতা আর শ্রদ্ধার কথা, ভুলে গেলাম আমি কখনো কোনো দুর্বলের গায়ে হাত তুলিনি। পায়ের জুতা খুলে অন্ধের মতো এলোপাতাড়িভাবে মারতে লাগলাম তাকে। সে কিছু না বলে তার রিকশা নিয়ে পালাবার চেষ্টা করল। আমি পেছন থেকে সিট টেনে ধরে আটকে ফেললাম। কোথা থেকে এতো জোর এলো আমার গায়ে আমি আজো জানি না।

ততক্ষণে বৃষ্টি কিছুটা ধরে এসেছে, ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেছে ডাক্তারের চেম্বারের সামনে। সবাই হা করে তাকিয়ে মজা দেখছে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে পেছন থেকে আমার ওড়না ধরে দাঁড়িয়ে আছে আমার ছেলে। কেউ কিছু বলছে না, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করছে না। আমি একহাতে রিকশার হ্যান্ডেল ধরে আরেক হাতে ব্যাগের ভেতরে কলমের জন্য হাতড়াচ্ছি।

কলম খুঁজে পাওয়ার পর যখন এক টুকরা কাগজে রিকশার নম্বর টুকে নিচ্ছি ঠিক তখনই ভদ্র গোছের এক পুরুষ এগিয়ে এসে বললেন, ‘আবার নম্বর টুকছেন কেন? অনেক তো পেটালেন, এবার ছেড়ে দিন’।

তার কথা শুনে আমার মাথায় আগুন ধরে গেল। রিকশাওয়ালাকে ছেড়ে তার দিকে তেড়ে গেলাম আমি, ‘আপনি কেন ওর তরফদারি করছেন? আপনি তো আমাকে জিজ্ঞেসই করেননি আমি কেন ওকে মারছি। আপনারা সবাই নীরবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন, কারণ আপনারা জানেন ও কী করে থাকতে পারে, কারণ এসব কাজ আপনারা সবাই কম-বেশি করে থাকেন’।

আমার হিন্দি ফিল্ম মার্কা ডায়ালগ শেষ হতে হতে রিকশাচালক তার প্রাণ আর রিকশা দুই নিয়ে পালিয়েছে। ডেন্টিস্ট বেরিয়ে এসেছেন ঘটনা কী দেখতে। ভিড়ের মধ্য থেকে একজন পুরুষ তার কাছে ব্যাখ্যা করছে, ‘মনো অয় রিশকাআলা বেটায় তান গাত আত দিলাইসে’।  

আশ্চর্য! লোকগুলো জানত কী ঘটেছে কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি, কেউ রিকশাওয়ালাটাকে কিছু বলেনি। এ দেশের পুরুষেরা সচরাচর রাস্তাঘাটে এরকম নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন না। সড়ক দুর্ঘটনায় ড্রাইভার ধরা পড়লে পিটিয়ে তার হাড্ডিমাংস এক করা হয়, একটা পকেট মার ধরা পড়লে গণপিটুনিতে তার প্রাণ যায়, অথচ একজন নারীর অপমান নীরবে দাঁড়িয়ে ফিল্মি কায়দায় দেখে এ দেশের পুরুষ। অনেকে আবার মুচকি মুচকি হাসেও। মেয়েরা কেন প্রতিবাদ করে না, তা এদের আচরণ দেখলেই বোঝা যায়।

রাগে আর অপমানে আর রিকশা নিতে ইচ্ছা করলো না। বৃষ্টির মধ্যেই ছেলের হাত ধরে হেঁটে বাসায় ফিরলাম। বৃষ্টির ঠাণ্ডা পানিতে মিশে একাকার হয়ে যেতে লাগল অপমানের উষ্ণ অশ্রু। বাসায় ফিরে ছেলে জিজ্ঞেস করল, ‘মা, তুমি ওকে মারলে কেন? ও তো তোমাকে কিছু করেনি’।

ছেলের প্রশ্নে হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি। কী বলব তাকে? কীভাবে বোঝাবো লোকটা কী করেছিল? চোখ মুছে নিয়ে কোনমতে বললাম, ‘অনেক খারাপ একটা কাজ করেছে বাবা। এসব  খারাপ কাজ দেখা যায় না’।

‘মা, ও যদি পুলিশের কাছে গিয়ে তোমার নামে বিচার দিত, পুলিশ কিন্তু তোমাকে জেলে দিত। তুমি যে ওকে মেরেছ এটা তো সবাই দেখেছে’। ছেলের সরল মন্তব্যে এতো কষ্টের মধ্যেও হেসে ফেললাম। ঠিকই তো বলেছে।

তারপরও বহুবার রাস্তায় রিক্সাওয়ালাদের জন্য ট্রাফিক পুলিশের সাথে ঝগড়া করেছি, র‌্যাবের হাত থেকে উদ্ধত লাঠি কেড়ে নিয়েছি কোন নিরীহ রিক্সাওয়ালাকে বাঁচাতে, কারণ প্রতিবাদ করা আমার কাছে শ্বাস-প্রশ্বাস নেবার মতই একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। নীরবে যে কোন অন্যায় আমি মেনে নিতে পারি না, হোক না সে অন্যায় আমার সাথে অথবা অন্য কারো সাথে।

কিন্তু যতবার কোন রিক্সাচালককে পুলিশের হাতে অথবা তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী প্যাসেঞ্জারের কাছে নির্যাতিত হতে দেখেছি, তখনই মনে হয়েছে একজন দরিদ্র রিক্সাচালক যার ক্ষমতা বা সাহস নেই নিজের অধিকারের জন্য মাথা তুলে দাঁড়ানোর, জীবনের প্রতি পদে পদে যাকে মাথা পেতে নিতে হয় শত অপমান আর নির্যাতন, সেও একজন নারীর গায়ে অবলীলায় হাত দিয়ে বসে, কারণ সে জানে লজ্জাই নারীর ভূষণ। একজন নারী হালকা পাতলা যৌন নির্যাতন গায়ে মেখে চুপ করে চলে যাবে, তবু দশজনের সামনে তা নিয়ে কথা বলবে না। নারীর এই লজ্জাপ্রসূত নীরবতাই একজন দুর্বল পুরুষকেও করে তুলে অসামান্য ক্ষমতাবান।

আমি বরাবরই আমার বাচ্চাদের সাথে যৌন নির্যাতন নিয়ে আলাপ করেছি, যাতে তারা নিজেদেরকে এসব থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে, এবং সেরকম কিছু কখনো ঘটলে আমাকে বলার সাহস রাখে। কিন্তু সেদিনের ঘটনার পর আমি প্রথম সিদ্ধান্ত নিলাম আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর কথা  তাদেরকে বলব এবং বলেছিও। নিজের মায়ের অভিজ্ঞতার কথা জানার পর ছেলেটা অন্যান্য মেয়েদের প্রতি আরো শ্রদ্ধাশীল হবে এবং মেয়েটা আরো সতর্ক হবে বলেই আমার মনে হয়েছে।

আমার নারীবাদী লেখাগুলোর জন্য অনেকে আমাকে বাহবা দেন, অনেকে তিরস্কার করেন। কিন্তু তাদের অনেকেই এই কথাটা বুঝবার চেষ্টা করেন না যে পুরুষের বিরোধিতা করা এসব লেখার উদ্দেশ্য নয়, বরং যে কোন নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেই লিখি। যেহেতু একজন নারী হিসেবে নানানভাবে নির্যাতিত হয়েছি আমিও এবং আমি নিজের অভিজ্ঞতার কথাই লিখি সেহেতু আমার লেখায় এসব কথাই উঠে আসে। যতদিন নারীর উপর নির্যাতনের মাত্রা আরো অনেক নিচে নেমে না আসবে, ততদিন এসব কথা আমাদেরকে বলতেই হবে। আমাদেরকে আরো সরব হতে হবে।

আমার এই লেখাটি পড়ে অনেকে হয়ত ভাবছেন, একজন রিক্সাওয়ালার হাতে লাঞ্ছিত হবার কথা বলতে কি আমার লজ্জা হলো না? আমি বলব যে লজ্জা নারীর পায়ে বেড়ির মত জড়িয়ে থেকে তার পথচলা আটকে রেখেছে এতোদিন, সে লজ্জাই  হোক নারীর চিরভূষণ, সমস্যা নেই। কিন্তু আসুন সেই লজ্জার হেতুটা আমরা পাল্টে দেই। আমার দুর্বলতা, আমার নীরবতা হোক আমার নতুন লজ্জা। আর আমার সবচেয়ে বড় লজ্জা হোক আমার নিজের অস্তিত্বের কাছে, সমাজের কাছে বা পুরুষের কাছে নয়।  নারীর অসহায়ত্ব আর সামাজিক লাঞ্ছনার ভয়কে পুঁজি করেই নারীর ওপর চলে আসছে অন্তবিহীন লাঞ্ছনা। আসুন সরব হই, বদলে দেই সমাজকে। শুধু আমাদের জন্য নয়, সবার জন্য।  

লেখক : নাট্যকর্মী ও প্রবাসী লেখিকা।

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।