স্বাধীন হয়েছি কি নতুন পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য?


প্রকাশিত: ০৪:১৯ এএম, ০৭ নভেম্বর ২০১৬

নাসিরনগর-হবিগঞ্জ-ছাতক-সুনামগঞ্জ-গোপালগঞ্জ-ঠাকুরগাঁও-নেত্রকোনা- তালিকা আরো লম্বা হলে অবাক হবো না। না, বিপিএল নিয়ে কিছু বলছি না। বলছি সাম্প্রদায়িক হামলা- মন্দির-মূর্তি ভাঙা, বাড়িঘর লুট করা, আগুন দেয়ার কথা।

হামলা শুরুর কাহিনী সবার জানা। সবারই ধারণা, রসরাজ নামের ওই লোকটির ফেসবুকের ছবিকে কেন্দ্র করেই এমন হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে সত্যটা হলো এই যে, রসরাজের ফেসবুক থেকে ছবিটি পোস্ট করা ছিল হামলার পূর্বপরিকল্পনার একটি অংশ। রসরাজ নিরক্ষর লোক, তিনি ফেসবুকে একটিভও নন। নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টটিও তার নিজের খোলা নয়। তার কোনো এক মুসলমান বন্ধু তাকে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়। এ সম্পর্কে কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যাপার সবার সামনে আনতেই -এই লেখাটির অবতারণা।
 
রসরাজের প্রোফাইলে তার একটি ছবি পাওয়া গেছে, যা পোস্ট করা হয় এ বছরের ২৭ জুন। প্রোফাইল পিকচারে ৩টি কমেন্ট করা হয় ২৭ জুন। কমেন্ট পড়ে বোঝা যায়, কমেন্টকারীরা তার পরিচিত বন্ধু এবং তারা প্রত্যেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের। ফেসবুকে তার প্রোফাইল ছবিটি ছাড়া আর কোনো পোস্টের প্রাইভেসি পাবলিক করা ছিল না।

রসরাজের অ্যাকাউন্টটি আগেই হ্যাক হয়েছিল, যা তার জানা ছিল না। ২২ অক্টোবর রসরাজের অ্যাকাউন্ট থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কিছু ছবি পোস্ট করা হয় এবং সাথে সাথেই সেটাকে ‘অনলি মি’ করা হয়। কীভাবে বুঝলাম? কারণ ২৭ জুন প্রোফাইল পিকচার দেয়ার পর সে দিন তার ছবিতে তার বন্ধুরা কমেন্ট করে। কিন্তু ২২ অক্টোবরে দেয়া ছবিতে কমেন্ট শুরু হয় ২৭ অক্টোবর থেকে। তাহলে তার ২২ অক্টোবরের ছবিতে কেন ২৭ অক্টোবর থেকে কমেন্ট করা শুরু হবে?

এটা স্পষ্ট যে, কেউ একজন রসরাজের আইডিটিকে আগে থেকে একটিভ এবং আওয়ামীভক্ত দেখাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি পোস্ট করে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী ফটোশপ ছবি পোস্ট করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি পাবলিক করে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে হিন্দু মানে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ মানেই হিন্দু, নাস্তিক, ইসলাম-বিদ্বেষী।
 
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, রসরাজকে ফেসবুকে একটিভ ইউজার দেখাতে তার আরো একটি ছবি আপলোড দেওয়া হয় ২৭ অক্টোবর। দিয়েই ছবিটা ‘অনলি মি’ করা হয়। পরে ঘটনা ঘটার পর সেটাকে ‘পাবলিক’ করে দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, রসরাজের এই ছবিতে তার কোনো পরিচিত বন্ধু-বান্ধবের কমেন্ট নেই। একটা মানুষ জুনে ফেসবুকে প্রথম নিজের ছবি দিলো, তারপর অক্টোবরে শেখ হাসিনার, তারপর ওখান থেকে কাবার। এর বাইরে রসরাজের আর কোনো ফেসবুক এক্টিভিটিই নেই। আগে কোনো একটা লেখা শেয়ার না দেওয়া, কোনো এক্টিভিটি না দেখানো লোক সরাসরি কাবার ছবি আপলোড দিয়ে দিলো? আর যে নিরক্ষর লোকটি নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট অন্যকে দিয়ে খোলান তিনি পাসওয়ার্ড চেঞ্জের ব্যাপারে যে সতর্ক থাকবেনই না -সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

পরবর্তী সময়ে রসরাজকে গ্রেপ্তার করা হয়, গ্রেপ্তারের পর পুলিশ হেফাজতে তার আইডি থেকে ছবিটি সে পোস্ট করেনি। তারপরও সবার কাছে সে ক্ষমা চাইছে- এরকম একটা স্ট্যাটাস দেয়া হয়। সেই স্ট্যাটাসের কমেন্ট বক্স রসরাজের ফাঁসির দাবি, খুনের হুমকি, হিন্দু ধর্ম নিয়ে ‘কটূক্তি’, গালাগালি জাতীয় মন্তব্যে ভরে ওঠে।

রসরাজ ওই ছবি পোস্ট করেননি- এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই আমি যথেষ্ট প্রমাণ দিতে পেরেছি। কে বা কারা ছবিটি পোস্ট করেছে সেটা বের করা সরকার-পুলিশ-প্রশাসনের জন্য কয়েক সেকেণ্ডের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু কেন সেটা বের করা হচ্ছে না? জানা গেছে, রসরাজের আইডিটি তিন জায়গা থেকে লগইন করা হয়েছিল।

এসব যদিও এত গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। কারণ যেখানে সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটাতে কোনো কারণ লাগে না বাংলাদেশে, সেখানে অফিসিয়ালি অনুভূতিতে আঘাতের একটা কারণ দেখিয়ে হামলা করা হয়েছে এটাই বা কম কী! অন্তত একটি কারণ তো পাওয়া গেছে।

এ ঘটনার পর ফেসবুকে একটি স্ক্রিনশট ভাইরাল হয়। জাহুরুল ইসলাম বুলবুল নামের একজন হিন্দুধর্মের কোনো দেবীকে কীভাবে কী করবে তা জানিয়ে একটি স্ট্যাটাস পোস্ট করেন। রসরাজ দাসের ব্যাপারটার সঙ্গে ব্যালেন্স করতে জাহুরুলকে গ্রেফতার করা হয়। তবে বুধবার আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ করে ওই রাতেই তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। পাবনার মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. জাহুরুল বলেন তার আইডি হ্যাক করা হয়, তিনি জানতেন না। একই ব্যাপার ঘটেছিল রসরাজের ক্ষেত্রেও। তবে রসরাজ হিন্দু হওয়ায় সে নিজে তো মুক্তি পায়নি, তার এলাকার হিন্দুদেরও ভয়ঙ্কর হামলা থেকে রক্ষা করতে পারেনি।

কেউ আবার ভেবে বসবেন না আমি ৫৭ ধারার পক্ষে সাফাই গাইছি। আমি শুধু দেখাচ্ছি, একই ধারা কীভাবে ব্যক্তির ধর্মবিশেষে বদলে যায়। ‘আইনের চোখে সবাই সমান’ -জাতীয় সিনেমার ডায়লগগুলোর বাস্তবতা দেখানোর চেষ্টা করছি মাত্র।

নাসিরনগরের এমন বড় আকারের হামলার পর টিভির টকশোগুলোতে এ ঘটনা প্রাধান্য না পেয়ে টেস্ট-ক্রিকেট-সিরিজে বেন স্ট্রোক আর সাকিবের স্যালুট কীভাবে প্রাধান্য পায় আমার জানা নেই। এটা কী অবহেলা, নাকি অন্য কিছু?

এ সংক্রান্ত খবরের লিংকের নিচে কিছু কমেন্ট পড়ে জানতে পারলাম, ‘মালুদের সাথে যা হয়েছে ঠিক হয়েছে’। আরও জানতে পারলাম, ‘মালুরা হাসিনার কাছ থেকে বাড়ি পেতে নিজেদের বাড়িতে নিজেরা হামলা চালিয়েছে, আগুন দিয়েছে’, ‘ঘটনা শুরু করেছে মালুরা, এখানে হামলাকারীদের কোনো দোষ নেই’। কয়েকজন সেলিব্রেটি ফেসবুকারের আইডি ঘুরে এসে মনে হলো বিটিভি দেখে এলাম। যারা ‘আই সাপোর্ট গাজা’, ‘সেভ গাজা’ ইত্যাদি হ্যাশট্যাগ দিয়ে ফেসবুক-টুইটার কাঁপিয়েছিলেন তারা ব্যস্ত আছেন ক্রিকেট নিয়ে; দেখলাম স্ট্যাটাস দিচ্ছেন, ‘আই সাপোর্ট রাজশাহী কিংস’।
 
একটা ব্যাপার পরিষ্কার নাস্তিকদের ওপর হামলা কিংবা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর হামলায় দেশের সাধারণ মানুষের কিছু যায়-আসে না। সঙ্গে যদি ধর্মীয় অনুভূতির অজুহাতজুড়ে দেয়া যায় তাহলে তো রীতিমতো হামলাগুলোকে সমর্থন করা হয়।

সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর প্রতিবাদ করছে মূলত অনলাইনের নাস্তিকেরা, ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ই যাদের কাজ। তারা গাজা ইস্যুতেও প্রতিবাদী ছিল, মিয়ানমারে সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্যও যারা লিখেছে, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হামলাতেও তারা প্রতিবাদ করছে। তাদের মগজে এটি ধারণ করার ক্ষমতা নেই, কারও মতের সঙ্গে দ্বিমত থাকলেও তার মতপ্রকাশের অধিকারের পক্ষে কথা বলা যায়। কারও অযৌক্তিক বিশ্বাস নিয়ে আমি আমার যুক্তি তুলে ধরবো। তার মানে এই নয় যে, তাকে শারীরিক আঘাত করে, তার ঘর-বাড়ি ভেঙে, জ্বালিয়ে দিয়ে তাকে আমার যুক্তি মেনে নিতে বাধ্য করবো। আমার যুক্তি দেখানোর যেমন অধিকার আছে, তারও অযৌক্তিক কিছুতে বিশ্বাস রাখার অধিকার আছে। আমি শুধু চাইব, সে যেন অন্ধবিশ্বাস ঝেড়ে যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে শেখে। সেজন্য আমি লিখব, যুক্তি উপস্থাপন করবো।

সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোতে বরাবরের মতো সরকারের ভূমিকা নীরব। প্রকাশ্যে ‘মালাউন’ বলে গালি দেয়া মন্ত্রী সসম্মানে তার পদে বহাল আছেন। শুধু লতিফ সিদ্দিকীরই মন্ত্রিত্ব গেল, ফাঁসির দাবি উঠল, তীব্র নিন্দা-প্রতিবাদ হলো। হামলার নীরব দর্শক হিসেবে দায়িত্বপালন  করা পুলিশ সদস্যরাও নিশ্চয়ই রাতে প্রমোশনের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন।

বাংলাদেশ ঠিক কী কারণে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়েছিল? পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে নতুন একটি পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার জন্য? এখনও বাংলাদেশে সাধারণত জনগণ যদি চায়, তাহলে সাম্প্রদায়িক হামলাগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব। এমনকি সবাই এক হয়ে প্রতিবাদ করলে দোষীরা চিহ্নিত হওয়া কোনো কঠিন কাজ নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয়, ধর্মপ্রাণ জনগণ কি তা চাইবেন?

লেখক : প্রবাসী ব্লগার

এইচআর/এবিএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।