আমার আপনার শিশু কি নিরাপদ?


প্রকাশিত: ০৪:১৮ এএম, ০৫ নভেম্বর ২০১৬

‘আমার ঘরে, আমার আঙিনায়, আমার মহল্লায়, আমার বাচ্চার এটা হতে পারে না, আমার পরিচিত কেউ এতটা পাষণ্ড হতে পারেন না’। এমন করে ভাবার আর সুযোগ নেই। আপনার শিশু এখন যে কারো বিকৃত বাসনা চরিতার্থ করার খোরাক হয়ে যেতে পারে। কন্যা হলে এই ভয় আরো বেশি। দুই, আড়াই বা পাঁচ বছর। খুব ছোট মনে হচ্ছে? না যারা আজ ধর্ষণের উৎসবে মেতেছে তাদের কাছে কোনো বয়সই বিবেচনার নয়।
 
অসংখ্য ঘটনা। কিছু মাত্র জানা যাচ্ছে। দু-একটা ঘটনা প্রচারের আলোয় এলে তা নিয়ে খানিক উচ্চবাচ্য, দোষারোপ, কিছু মিছিল-মিটিং আর সমাবেশ হয়। আমরা হয়তো জানতেও পারি না কত অসংখ্য পরিবারে বা পরিচিত পারিপার্শ্বিকে প্রায় প্রতিদিন বিকৃত যৌন নির্যাতনে হারিয়ে যাচ্ছে কত শৈশব। শিশুর ওপর অধিকাংশ যৌন হেনস্তার ঘটনা পরিবারের মধ্যেই চেপে যাওয়া হয়। ‘ছোট ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে জঘন্য যৌনাচারের ঘটনা সচরাচর ঘটে না’, এমন ধারণা থেকে আমাদের সবাইকে বের হয়ে আসতে হবে। কারণ এমন বিশ্বাসই ধর্ষণকারীকে আরো আশকারা দিচ্ছে।

বিকৃতকাম মানুষের ‘কোমল লক্ষ্য’ এখন শিশু। শিশুকে সহজে ভুলিয়ে আয়ত্তে আনা যায়। দরিদ্র পরিবারের হলে সামান্য চকোলেটের টোপেই পাওয়া যায়। অধিকাংশ সময় বাচ্চাটি বুঝতেই পারে না তার সঙ্গে কী হলো। ফলে কাউকে ভালো করে বোঝাতে বা জানাতে পারে না। আবার বুঝতে পারলেও তার প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের ক্ষমতা থাকে না। খুব সহজে এদের দাবড়ে, ভয় দেখিয়ে, শক্তি প্রয়োগ করে বিষয়টা ধামাচাপা দেয়া যায়।

সত্যি বলতে কী, আমাদের দেশে শিশু-ধর্ষণ নিয়ে একটা রাখঢাক ভাব অনন্তকালের। ভাবা হয়, শিশু ঠিক সবকিছু ভুলে যাবে। বরং এ নিয়ে হইচই করলে শুধু শুধু তার ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, পরিবারের সম্মান যাবে -এই মানসিকতা একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। বাইরের মানুষ তো বটেই, পরিবারের একেবারে নিকটজনের দ্বারা কত শিশু বিকৃতির শিকার হয়, তার কতটুকুইবা জানা যায়। 

প্রশ্ন হলো কী করণীয়? নিশ্চয়ই আরো সতর্ক হতে হবে অভিভাবকদের এবং কিছু ক্ষেত্রে স্কুলকে। সাম্প্রতিককালে একের পর এক শিশু ধর্ষণের ঘটনা আমাদের চিন্তাকে বদলে দিয়েছে। শুধু টিনএজার বা যুবতীরাই ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, এমন ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শিশু মেয়ে যেমন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশু ছেলেও যৌন অত্যাচার থেকে নিরাপদ নয়।

সময় এসেছে স্কুলের পাঠ্য নিয়ে ভাবার। একটা নির্দিষ্ট ক্লাস পর্যন্ত একটা পাঠ্য এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। স্কুলের পরিবেশও এমন রাখতে হবে যেন কোনো শিক্ষকের বা সহপাঠীর কোনো আচরণ ভালো না লাগলে দ্বিধাহীনভাবে তা বলতে পারে, সমাধান স্কুলেই শেষ হতে পারে।
 
আর বাড়িতে অভিভাবকদের ভাবতে হবে আরো নিবিড়ভাবে। পরিস্থিতিবিশেষে আত্মীয় বা প্রতিবেশীর কাছে দীর্ঘক্ষণের জন্য না পাঠানো, পাঠালেও খোঁজ নেয়া। একটু জ্ঞান হওয়ার পর সামাজিক সৌজন্যবোধ শেখানোর মতোই শিশুকে শেখাতে হবে, সবার সামনে জামা খুলতে নেই, শেখাতে হবে, কেউ জোর করে কোলে বসাতে চাইলে, জবরদস্তি চুমু খেলে, যৌনাঙ্গে বা স্তনে হাত দিলে মাকে বা ভরসার কাউকে এসে বলতে হয়। শেখাতে হবে, পরিচিত-অপরিচিত কেউ চকোলেট, পুতুল বা কোনো কোমল পানীয় দিয়ে ডাকলেই তার সাথে যেতে নেই।

আসলে এখন আর কিছু করার নেই। কারণ কারো শিশু নিরাপদ নয়। তাই তার নির্ভেজাল, অমলিন শৈশবকে খুন করে শিশুকে এখন শেখাতে হবে তার জন্য পৃথিবীটা কতটা কুৎসিত। শিশুর মনে ঢুকিয়ে দিতে হবে প্রাপ্তবয়স্কদের যে কেউই তার জন্য বিপজ্জনক। অনেকেই এ বিষয় দ্বিমত করতে পারেন, কিন্তু সতর্ক না হলে শিশু ধর্ষিত হলে তার শৈশব তো বটেই, জীবনও তছনছ হয়ে যেতে পারে।

শিশুর কথাকে গুরুত্ব দিতে হবে পরিবারের বড়দের, উড়িয়ে দেয়া যাবে না। তার সব কথা ‘ফালতু’ বলে উড়িয়ে দেয়ার আর সুযোগ নেই। প্রতি দিন বাড়িতে, স্কুলে, পাড়ায় শিশু কার কার সঙ্গে কী কী করল, তা খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করতে হবে।  কোনো অস্বাভাবিক ক্ষত বা দাগ দেখলে -সেটা কী করে হলো শিশুর থেকে জানতে হবে। যেসব বাচ্চা স্কুলবাসে বা বাড়ির গাড়িতে শুধু ড্রাইভারের সাথে যাতায়াত করে তাদের বাবা-মাকে অতিরিক্ত সতর্ক হতে হবে। শিশুকে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করতে হবে, যাওয়া-আসার পথে যারা দেখভাল করে, তারা কেউ তার গায়ে হাত দেয় কিনা, কোনোভাবে তাকে আঘাত করেন কিনা। বাচ্চা একা গৃহশিক্ষকের কাছে পড়লে নজর রাখতে হবে। দেখতে হবে শিক্ষক কথায় কথায় তাকে অন্যভাবে স্পর্শ করছে কিনা।

এখন থেকে প্রতিটি পরিবার তার ছোট ছেলেটিকে ছোটবেলা থেকে মেয়েদের সম্মান করতে শেখাক। বীজ বপন শুরু করতে হবে -এমন এক নতুন প্রজন্মের, যারা ছোট থেকে মেয়েদের দেহসর্বস্ব যৌনবস্তু আর না ভাবে। মানুষ যেন ভাবে।

শিশু ও নারী ধর্ষণ, নির্যাতনের ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। এই সংখ্যা বছর বছর কেবল বাড়ছেই। যেসব প্রকাশিত হয় তার চেয়ে অপ্রকাশিত ঘটনা ঢের বেশি। আমাদের গণমাধ্যম ধর্ষণের সংবাদে মনোযোগী হয়েছে। আগের চেয়ে গণমাধ্যম কর্মীরা অনেক বেশি স্পর্শকাতর বিষয়ে, নারী ও শিশু বিষয়ে নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি মাথায় রাখছে। এই সচেতনতা আরো বেশি প্রয়োজন। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিবিড় নজরদারি, ধর্ষক ও যৌন নির্যাতকদের ব্যাপারে কোনো ছাড় না দেয়া, দ্রুততম সময়ে তাদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। যে মনোবৃত্তি পুরুষদের একটি অংশকে ধর্ষকে পরিণত করে, যে সংস্কৃতি ধর্ষণের শিকারকে সামাজিকভাবে লাঞ্ছনা করে এবং যে অপরাধ দমন ব্যবস্থার ফাঁকফোকর গলে নির্যাতকেরা বেরিয়ে যেতে পারে, সেসবের সংস্কার প্রয়োজন। ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন বেগবান হোক, সরকার সর্বশক্তি  নিয়োগ করুক। আপস, শিথিলতা এমনকি লোকলজ্জায় ঘটনা চেপে রাখার আর সুযোগ নেই।

Ishtiaque

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।