অন্ধকার সেই দিনের কথা


প্রকাশিত: ১১:৪০ এএম, ০৩ নভেম্বর ২০১৬

মৃত্যুকে জয় করেই কেউ কেউ হয়ে ওঠেন মৃত্যুঞ্জয়ী। কখনো কখনো হয়ে ওঠেন আরও বেশি শক্তিশালী, বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতার ক্ষেত্রেই ঘটা ঘটনাও এমনি। ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের খুনিরা বুঝে গিয়েছিলো যে বঙ্গবন্ধু কেবল একজন নেতা নন একটি আদর্শের নাম যে আদর্শের প্রতিফলন ঘটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আর তা পরিপূর্ণভাবে ধারণ এবং লালন করে চলেছেন তাঁর চার যোগ্য অনুসারী। যাঁদের প্রতিটি রক্তকণায় ছিল বাংলাদেশের নাম।

আর তাই কেবল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেই মনোবাসনা পূরণ হবার নয়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র তা যেন কোনো অবস্থাতেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, বাংলাদেশ যেন পুনরায় পাকিস্তানের সাথে একীভূত হতে পারে সেই অপচেষ্টা চলতে থাকে। তার জন্য বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সবচেয়ে ঘৃণিত বিশ্বাসঘাতক সদস্য হিসেবে পরিচিত এবং তৎকালীন স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক আহমেদের প্ররোচনায় একশ্রেণির উচ্চাভিলাষী মধ্যম সারির জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা বিশ্ব ইতিহাসের কলঙ্কজনক দিন ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সবাইকে বীভৎস হত্যাকাণ্ডের কিছুকাল পরেই দেশের শ্রেষ্ঠ চার সূর্য সন্তান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে কারাগারে পাঠিয়ে ৩ নভেম্বর ভোর সারে ৪টায় প্রথমে গুলি এবং পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। বাঙালি জাতির জীবনে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে সুখময় এবং গৌরবময় ঘটনার নায়কদের জীবনাবসানের সাথে সাথেই বাঙালি জাতির জীবনের আলো একুশ বছরের জন্য এখানেই নিভে যায়।

জাতীয় এ চার নেতা বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দান করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্র, কৃষি এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলী গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনায় নীতি ও কৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদান ছিল অসামান্য, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে এই চার নেতা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানের মাধ্যমে বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বতন্ত্র জাতি রাষ্ট্রের স্বপ্নপূরণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তাঁরা পুনরায় ঝাঁপিয়ে পড়েন কর্মযজ্ঞে, কাজটা খুব সহজ ছিলো না। সদ্য স্বাধীন হওয়া এ দেশটির অবকাঠামো বলতে তেমন কিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না। পাকিস্তানিরা রাজাকারদের সহায়তায় এ দেশকে এক ধ্বংসস্তূপ আর মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছিল। এই বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে প্রয়োজন ছিল প্রচুর সময়, অর্থ আর জনবল। নতুন দেশ গঠনে হাতে হাত রেখে কাজ করার বিপরীতে নেতৃস্থানীয় কয়েকজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা যেন দেশ বিধ্বংসী হয়ে উঠলেন, গঠন হল জাসদ। জাসদ সরাসরি হত্যাযজ্ঞের সাথে জড়িত না থাকলেও হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট তৈরিতে তাদের কালিমাযুক্ত ভূমিকা জাতি সারাজীবন তীব্র ঘৃণা নিয়ে স্মরণ করবে।

ওদিকে ঝুড়িতে থাকা বিষাক্ত সাপ খোন্দকার মোশতাক দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে চক্রান্তে লিপ্ত। পেছন থেকে সমর্থন জুগিয়ে চলেছেন আরও অনেকে যারা পরে ক্ষমতার মসনদে আসীন হয়েছিলেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বর বাংলাদেশে কেবল দুটি নিকৃষ্ট হত্যাকাণ্ডই সংগঠিত হয়নি বাংলাদেশের মেরুদণ্ড চিরদিনের মতো গুঁড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম নীলনকশার অংশ ছিল এটা। কিন্তু সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে এক বিস্ময়ের নাম। গত আট বছরে এ দেশে অভূতপূর্ব সব আশা জাগানিয়া ঘটনা ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর চার যোগ্য উত্তরসূরি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে স্বপ্নের বীজ আমাদের মননে রোপণ করেছিলেন আজ তা বাস্তব হবার পথে। বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতাকে আমরা স্মরণ করবো তাঁদের দেখানো পথে হেঁটে, দেশকে তাঁদের মতো করে ভালোবেসে, ‘মানুষ মানুষের জন্য’ - এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে।

লেখক : অধ্যাপক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এইচআর/এবিএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।