কমিউনিস্টরা বাম গণ্ডি পেরোবে কবে?
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাউন্সিল শেষ না হতেই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির চারদিনের একাদশ কংগ্রেস শুরু হলো শুক্রবার। সরকারি দলের সম্মেলন নিয়ে যতটা আলোচনা আর উচ্ছ্বাস, সিপিবি’র কংগ্রেস নিয়ে যেন ততটাই নীরবতা। কেন এমনটা হলো? তবে কি পার্টির সঙ্গে সমাজের যোগাযোগ একেবারে কমে গিয়েছে?
বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা কতটা কমিউনিস্ট হতে পেরেছে, আর কতটা ‘বাম’ গণ্ডিতে রয়ে গেছে সে এক বড় প্রশ্ন। সিপিবি তার ঘোষণাপত্রে বলে, “কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও দণ্ড কার্যকর করা সম্ভব হলেও, সমাজ ও রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িকীকরণ বিপজ্জনকভাবে বেড়ে চলেছে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন-হামলা বাড়ছে। সাম্রাজ্যবাদ একদিকে এসব সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের জন্ম দিচ্ছে, লালন করছে; একইসাথে তারাই আবার জঙ্গিবাদ দমনের অজুহাত তুলে দেশে তাদের নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ বাড়ানোর পায়ঁতারা করছে”। এই বক্তব্যের সাথে দ্বিমত করবে এমন মানুষ কম। তবুও এই দলের কংগ্রেসে সাধারণ মানুষের উৎসাহ কম।
নিজেই বলছে, “বুর্জোয়া দলগুলোর ব্যর্থতা ও দেউলিয়াপনা দেশকে বিপর্যয়ের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে কমিউনিস্ট পার্টিকে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে”। কিন্তু কি সেই শক্তিশালী ভূমিকা তা পরিষ্কার নেই। পরিষ্কার নেই কারণ, পার্টি কমিউনিস্ট হয়েও একটা তথাকথিত বাম গণ্ডিতে আটকে আছে। সিপিবি’র এই কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত কি বার্তা দিবে জানা নেই। তবে গণআন্দোলনের পথে দলের ভিত্তি প্রসারিত করতে বাম গণ্ডির সীমা ছাড়িয়ে বৃহত্তর গণ্ডিতে দলকে নিয়ে যাওয়া যাবে কিনা সেই বিতর্ক প্রয়োজন দলের ভেতরে বাইরে। আজকের বাস্তবতায় সেটাই পার্টি লাইন হতে পারে। শুধু স্টিরিও-টাইপ স্লোগান-নির্ভর বাম ঐক্যের ডাক থেকে বেরোতে না-পারলে তারা জাতীয় রাজনীতিতে আরও কোণঠাসা হবে।
কমিউনিস্ট আন্দোলন কোনও কালেই শুধু সাধারণ আন্দোলন নির্ভর ছিল না। তা হলে এখন কেন দলটি বা দলগুলো শুধু পরিবেশ, প্রতিবেশ, দ্রব্যমূল্য ভিত্তিক আন্দোলনের রক্ষণশীলতায় আটকে আছে? সামাজিক শক্তিগুলির পুনর্বিন্যাসের সুযোগ তৈরিতে ভূমিকা চোখে পড়ছেনা কমিউনিস্টদের দিক থেকে। বলতে দ্বিধা নেই বামপন্থিরা যেসব জনপ্রিয় দাবি দাওয়া করেন তাদের আন্দোলনের অনেক দাবিই সরকারি প্রশাসন নিজেদের দিকে টেনে নেয়। সিপিবি’র এই কংগ্রেস নতুন কি স্বপ্ন হাজির করবে মানুষের সামনে তা কেবল শেষ হলেই বোঝা যাবে। কারণ এদেশে তারুণ্যের কাছে একটি প্রশ্নের উত্তর আজও হাজির করতে পারেনি সিপিবসহ এদেশীয় কমিউনিস্টরা। সেই প্রশ্ন হলো, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেও কেন সোভিয়েতের পতন হল? কারণ যদি তাদের জানাই থাকে তাহলে তার থেকে শিক্ষা নেয়াই ছিল আমাদের কমিউনিস্টদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বামপন্থিরাও ভোটের রাজনীতি করে। সেই রাজনীতি বিশ্লেষণও যদি করি তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, আওয়ামী লীগের লোক আওয়ামী লীগকে ভোট দিবে, বিএনপি’র লোক বিএনপিকে দিবে, জামায়াতের লোক জামায়াতকে দিবে। বিএনপি-জামায়াত- মৌলবাদিরা জোটও বেঁধেছে। প্রশ্ন হলো, সমাজে যে আরো নির্মোহ, নিরপেক্ষ মানুষ আছে, তাদের ভোট কেন পায়না কমিউনিস্ট বা জনপ্রিয় শব্দ বামেরা?
বামপন্থি রাজনীতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে একটা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। বামপন্থিরা এসময়ের চাহিদা পূরণের জন্য যতটা তৎপর হওয়া উচিত ছিল, ততটা হতে পারেননি। তারা এখনও কিছু ধ্যান-ধারণা আঁকড়ে আছেন, যা আজকের দিনে প্রাসঙ্গিক নয়। বামপন্থিদের আসলে বদলাতে হবে। তাদের মধ্যে রক্ষণশীলতা আছে অনেক, সেসব ভাঙতে হবে। বামপন্থি আন্দোলনের ডানাকে আরও প্রসারিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। মানুষের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এবং সামাজিক সঙ্কটের প্রেক্ষিতে বামপন্থি আন্দোলনকে লোকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, বামপন্থিদের আবার রক্ষণশীলতা কোথায়? বামপন্থিরা যে এখনও ধর্মঘট করেন, সেটা রক্ষণশীলতারই পরিচায়ক। পৃথিবীতে যেখানে বামপন্থিরা নেই বা দুর্বল, সেখানেও শ্রমিকেরা ধর্মঘট করে। তাহলে বামপন্থিরা আলাদা কি করেন? শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে ধর্মঘট পৃথিবীর সর্বত্র হচ্ছে। সেখানে কমিউনিস্ট-অকমিউনিস্টদের মধ্যে তফাত নেই। তফাত করতে হলে মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম এবং দাবি আদায়ের লড়াইকে নতুন ধারায় দেখতে হবে। রক্ষণশীলতা এখানেই যে, এরাও সাধারণ রাজনীতি করে, এদের নেতা কর্মীরা এনজিওদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গলা চড়ায়। সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ, আদিবাসী, সংখ্যালঘুদের ও নারী অধিকারের জন্য কমিউনিস্ট তথা বামপন্থিদের যতটা সংগ্রাম করা দরকার ছিল, তা তারা করতে পারেনি।
সক্রিয়তা এবং আদর্শগত ত্রুটি এক কথা নয়। আদর্শগত ত্রুটি না থাকলেও কমিউনিস্ট পার্টি যথেষ্ট সক্রিয় হতে পারেনি মানুষের ইস্যুতে। চা শ্রমিকের শত বছরের বাসস্থান কেড়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল হয়, আদিবাসী আর সংখ্যালঘুরা কেবলই ঠিকানা হারায়। কিন্তু আজ অব্দি কমিউনিস্টরা এসব বিষয়ে একটা গণআন্দোলন করতে পারেনি। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে বামেদের একটা বড় উপস্থিতি থাকার পরও সেসব ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বিভাজিত সংগঠন। কৃষকের কথা বলেন তারা, কিন্তু গ্রামীণ মানুষকে টানতে পেরেছেন কতটা? পারেননি বলেই আন্দোলন এগোয়নি।
সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক ভাবে বামপন্থি আন্দোলনের ব্যর্থতা আছে। সোভিয়েতের ভেঙে যাওয়ার পরে আন্তর্জাতিক ভাবেই কমিউনিস্টরা ব্যাকফুটে। ইতিহাসে এ রকম পিছিয়ে পড়তে হয় কখনো কখনো। বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চলছে, সেই ব্যবস্থা ব্যাপক মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারেনি। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, কোটিপতি বেড়েছে, হতদরিদ্র কমেছে। কিন্তু তবুও স্বীকার করতে হবে যে, কমিউনিস্টদের রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা মুছে যায়নি। সিপিবি নেতাদের সময় এখন আত্মসমীক্ষা, আত্মমূল্যায়ন এবং আত্মশুদ্ধির কথা ভাবার। কংগ্রেস থেকে প্রত্যাশা, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজনৈতিক দিশাকে নব কলেবর দিয়ে মানুষের আরও কাছাকাছি পৌঁছুতে প্রচেষ্টা করবেন নেতারা।
এইচআর/এমএস