গরুর রচনা ও আগামী প্রজন্ম


প্রকাশিত: ০৪:০৮ এএম, ২৫ অক্টোবর ২০১৬

ছোটবেলায় স্কুলের পাঠ্যসূচিতে আমাদের কেন গরুর রচনা মুখস্থ করানো হতো, কেনইবা এখনো ছাত্রগণ ঘ্যানর ঘ্যানর করে গরুর রচনা মুখস্থ করে! ভাবতে অবাক লাগে! চারটা পা, দুটো শিং, একটি লেজ এবং শরীরের কাঠামো বর্ণনা করে গরুকে চেনানোর কী আন্তরিক প্রচেষ্টাই না থাকে শিক্ষকগণের! অথচ খামারে কিংবা মাঠে চড়ে বেড়ানো মাত্র একটি গরুকে দেখিয়ে সারা পৃথিবীর যাবতীয় ব্র্যান্ডের গরুর আদ্যোপান্ত মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যেই একটি শিশুকে জানানো সম্ভব। জীবন কতটাই বা উৎকৃষ্টতর বানাতে পেরেছি গরুর রচনা মুখস্থ করে!

নদী ঘাস ফুল লতা পাতা, ফল ফলাদি আর গোটা দশেক জড় পদার্থের আত্মকাহিনী পড়ে আমরা কতখানি শিক্ষিত হয়েছি? স্কুল যদি শিশুর শিক্ষা কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে থাকে আমি মনে করি সেক্ষেত্রে অবশ্যই শিশুদের পড়ানো উচিত মানুষ নিয়ে রচনা। তাহলে শিশুকাল থেকেই তারা অন্তত মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে। মানুষ কত প্রকার ও তাদের ধরন, মানুষের মৌলিক স্বভাব- নির্মিত স্বভাব, চরিত্রের ভয়ংকররুপ- দয়ালুরুপ সম্পর্কে জানতে পারবে। হাজার হাজার দু-পেয়ে মানুষ আকৃতির প্রাণির মধ্যে থেকে খুব সহজেই মানুষকে চিনে নিতে পারবে।

শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন, যৌবন থেকে তারুণ্যে পদার্পণের এই সময়গুলো তাদের কাছে সত্যিই অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যের হয়ে উঠতো শুধু মানুষ চেনার কারণে। তারা জানতে পারতো  শুধু মানুষকে ভালোবেসেই একজীবন উৎসর্গ করা যায়- করেছে অসংখ্য মানুষ। চলার পথে প্রতি পদে ঠেকে ঠেকে শেখার বা মানুষ চেনার চূড়ান্ত মানসিক অবসাদ থেকে কিছুটা হলেও তারা নিজেদের বাঁচাতে পারতো। উচ্চতর শিক্ষার্থে অনেকেই মূল বিষয় হিসেবে বেছে নেয় মনোবিজ্ঞান। মানুষের মনের হাজারো বিশ্লেষণ এখানে তাই মানুষকে জানারও অপার সুযোগ ঘটে এখানেই। কিন্তু কয়জন সেই সুযোগ পায়?

বিজ্ঞান-মানবিক ও বাণিজ্যিক বিভাগের মাধ্যমে পাঠ্যবিষয়গুলোর শাখাবিন্যাস করা হয়েছে সুতরাং ইচ্ছে থাকলেও নির্দিষ্ট শাখার বাইরের ছাত্রগণ পছন্দের বিষয় হিসেবে মনোবিজ্ঞানকে নিতে পারে না, জানতেও পারে না মানুষের বৈচিত্র্যময় মনের জগতকে। বড়দের জন্য নয়- একটি নির্দিষ্ট বয়সের ছাত্রের জন্য নির্ধারণ করা হয় গরুর রচনা, ঠিক তাদের জন্যেই নির্ধারণ করা হোক মানুষের রচনাটিও। তারা জানুক মানুষের ইতিহাস। তারা জানুক তাদের গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগিয়ে চলছে যেমন মীরজাফরের জাতগোষ্ঠী, ঠিক তেমনি চলছে আজাদ-বদি আর রুমিদের মতো বীরগণ। শুধু চেনাটা শিখতে হবে। শুধু সঙ্গ বেছে নেয়াটা শিখতে হবে।  

গরুর রচনা পড়া ছাত্র যখন কারো সন্তান, সন্তানটি তখন কাদামাটি! সুন্দর একটি ছাঁচে ভরে খুব সহজেই তাকে পছন্দের আকৃতি দেয়া সম্ভব। এই ছাঁচটি হলো স্কুল। আকৃতি দেয়ার কাজটি করেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ। নিশ্চিন্তে স্কুলের শিক্ষকগণের ওপর নির্ভর করতে পারবেন অভিভাবক এমনটাই আশা করেন, আশা করেন তার কাদামাটি সন্তানটি আদর্শ, শিক্ষা, সভ্যতা আর মানবিক গুণাবলীর সমন্বয়ে সুন্দর একটি আকৃতি পাবে। সন্তানরা পড়ালেখা বিষয়ে শিক্ষকদের সিদ্ধান্তকে প্রধান্য দেয় মা-বাবার চেয়ে হাজারগুণ বেশি। অভিভাবক মাত্রেই এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত। শিক্ষক ভুল করলেও কাদামাটি ছাত্রের কাছে সেই ভুলটাই সঠিক। সে কিছুতেই ভুল সংশোধন করতে রাজি হয় না। বলে- এটা আমার টিচার শিখিয়েছে, মা তুমি কিচ্ছু জানো না। সত্যিকার বিপত্তি ঘটে তখনই যখন অভিভাবক টের পান তার সন্তান আদর্শগত কিছু জায়গায় শিক্ষক দ্বারা পথভ্রষ্ট হচ্ছে। যেহেতু ছাত্রের কাছে তার শিক্ষকের প্রাধান্য বেশি থাকে সেক্ষেত্রে অভিভাবকগণ বিষয়টি মোকাবেলা করতে হিমশিম খান।

আমার ছেলে তার কোচিং মিস এর খুব প্রশংসা করে। মিস নাকি পড়ার ফাঁকে সুন্দর সুন্দর গল্প শোনায়। জিজ্ঞাসা করলাম, কী গল্প শোনায় বাবা? সে জানালো মিস আজ তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনিয়েছে। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতা করলেই নাকি আমাদের সবার খুব উপকার হতো। বঙ্গবন্ধুর কারণেই যুদ্ধের সময় লাখ লাখ মানুষ মরেছে।’ ছেলের মুখে এটুকু শুনেই আমি হতবাক! কী শেখাচ্ছে এই শিক্ষক! শুধু বললাম বাবা, তোমার মিস দেশের স্বাধীনতা চায়নি। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আমাদের মহান স্বাধীনতার শত্রু রাজাকার, আলবদর কিংবা আলশামস পরিবারের তিনি কেউ একজন হবেন।

মিস এর এসব বানোয়াট গল্প কখনো বিশ্বাস করো না। আমি তোমাকে জানিয়েছি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস। আমি তোমার মা, তোমাকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে তোমার মা-ই সঠিক। খেয়াল করলাম ছেলে আমাকে সায় দিলো অর্থাৎ সে আমাকেই বিশ্বাস করবে ব’লে জানালো কিন্তু মুশকিলটা অন্য জায়গায়। এইসব শিক্ষকদের কাছ থেকে সন্তানদের কতক্ষণ আড়াল করে রাখা আমার  আপনার পক্ষে সম্ভব! কিংবা সন্তানকে সংশোধিত তথ্য জানানোর পর্যাপ্ত সময় আমি আপনি নাও পেতে পারি। কারণ সবকিছু সন্তানরা এসে মা-বাবাকে বলে না। হয়তো আমাদের অজান্তেই খুব নীরবে সন্তানের ভেতরে বিষ ঢুকে যাচ্ছে। একবার মনের ভেতরে গেঁথে যাওয়া বিষকে নিঙড়ে বের করা অনেক কঠিন। যেহেতু সন্তানটি আমার কাদামাটি। নরম মনে এসব বিভ্রান্তির ছাপ শুকিয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সময় পেলে প্রচণ্ড ক্ষতির সম্মুখীন হবে আমাদের সন্তান এবং সেইসাথে আগামী প্রজন্ম।

অভিভাবকদের জন্য এই তথ্য নিঃসন্দেহে খুব ভীতিকর। সন্তানের আদর্শগত বিচ্যুতি ঘটুক সেটা কোন অভিভাবকই চাইবেন না। পাঠ্যসূচির বাইরে ছাত্রদের বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়ে পথভ্রষ্টকারী এমন শিক্ষকের সংখ্যা প্রচুর। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক পাঠ্যপুস্তক যেমন সঠিক তথ্যনির্ভর হওয়া প্রয়োজন ঠিক তেমনি শিক্ষকদের পাঠদান বিষয়ক কঠোর নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। প্রয়োজন সরকার কর্তৃক যথাযথ মনিটরিং ব্যবস্থাও। সন্তানদের কল্যাণের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাদের বন্ধু হওয়া কারণ সন্তান মা-বাবার কাছ থেকে কোন কারণে ভয় পেয়ে তথ্য লুকালেও লুকাতে পারে কিন্তু তার বন্ধুর কাছ থেকে কখনো লুকাবে না। আমরা অভিভাবকগণ একত্রিত হয়ে অনেকরকম বিভ্রান্তির বিপক্ষে হয়তো আন্দোলন করতে পারি কিংবা পারি না, সে সময় কোথায়! কিন্তু সন্তানের বন্ধুতো হতে পারবো। আমার আপনার সন্তান মিলেইতো আগামী প্রজন্ম। সব আশংকা কাটিয়ে শুদ্ধতায় ভরে উঠুক চারপাশ।

লেখক :  ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।