বাংলাদেশ আমেরিকার চেয়ে ভালো


প্রকাশিত: ০৪:০৬ এএম, ২৪ অক্টোবর ২০১৬

পশ্চিমের প্রতি অহেতুক দুর্বলতা আমাদের অনেকেরই। অনেকেই মনে করি, পশ্চিম মানেই উদার, পুব অনুদার, পশ্চিম মানেই আধুনিক, পুব অনাধুনিক, পশ্চিম মানেই সাংস্কৃতিক, পুব অসাংস্কৃতিক, পশ্চিম মানেই সুন্দর, পুব অসুন্দর, পশ্চিম মানেই ভালো, সকল মন্দ পুবে।

এখনও সাদাদের দেখলে, তাদের শ্রেষ্ঠ বলে ভাবতে ভালো লাগে আমাদের। তাদের সবকিছু ‘বড় আর উঁচু’ বলে মনে হয়। জ্ঞান, মেধা, প্রজ্ঞা, প্রতিভা সবই। যদিও বাস্তবতা তা নয়, বরং কখনো সখনো উল্টো। অমন ভাবনার অবশ্য একটি প্রত্মসাংস্কৃতিক কারণ রয়েছে। দীর্ঘ ঔপনিবেশিকবাস আমাদের মনোদাস বৃত্তিকে জিইয়ে রেখেছে ভেতরে ভেতরে। এখনও নিজেদের অনেকেরই গায়ের কাপড় খুললে বুকে-পিঠে চাবুকে, আঘাতের, ক্ষতের প্রত্মচিহ্ন পাওয়া যাবে। তা নয় তো, সাদাদের জন্য, পশ্চিমাদের জন্য অত হাহাকারই বা কেন আমাদের?

মার্কিন নির্বাচনের আর কদিন বাকি মাত্র। সেখানে নির্বাচনকে ঘিরে যে টাকার খেলা, দলাদলি, কাদা ছোড়াছুড়ি, পারস্পরিক বিষোদগার, যে অসাংস্কৃতিক আচরণের চর্চা তা কতটা উদার, গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করে সে এক বিশাল প্রশ্ন।

যৌনঅস্ত্র নির্বাচনের আরেক অশ্লীল হাতিয়ার। জেসিকা লিডসে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন প্রথম, বলেন ট্রাম্প একবার এক উড়োজাহাজে জড়িয়ে ধরে চুমু খান তাকে। ঘটনা আশির দশকের। তার কদিন পরই আরো দু’নারী। একজন সামার জাভোর্স। যিনি একসময়ে ট্রাম্পের রিয়েলিটি শো ‘দ্য অ্যাপ্রেনটিস’ এর প্রতিযোগী ছিলেন। অভিযোগ, ক্যালিফোর্নিয়ার একটি হোটেলে ট্রাম্প তাকে ডেকে নিয়ে জোর করে চুমু খেতে চেয়েছিলেন। জোর করে যৌন সম্পর্ক করবার চেষ্টা ছিল, ট্র্যাপ করেছিল ট্রাম্প তাকে অমন অভিযোগ তার। ঘটনাকাল ২০০৭।

আরেক নারী সাবেক মডেল। ক্রিস্টিন অ্যান্ডারসন। নিউইয়র্কে একটি ক্লাবে ট্রাম্প অনাকাক্ষিতভাবে জড়িয়ে ধরেন তাকে। অতর্কিত পোশাকের ভেতর হাত চালিয়ে দেন। এমনভাবে করেন, যেন তিনি কিছুই করেননি। ঘটনা নব্বই এর দশকের।

ঘটনার সবই ঘটেছে আগে, আলোচনা হচ্ছে এখন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। যৌন হয়রানির অভিযোগ বেশ জমে উঠেছে। রগরগে আলোচনা মুখে মুখে। আইএমএফ এর প্রেসিডেন্ট ফিলিপ ট্রসক্যান কিংবা ইতালির বার্লোস কুনির বিরুদ্ধে আনা যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে তুলকালামের ঘটনা অনেকেরই মনে আছে নিশ্চয়ই? ‘বিশেষ’ সময়ে ‘বিশেষ’ অভিযোগ। পশ্চিমের অনেক দেশেই এটা রীতিমতো রীতি, সংস্কৃতি।

ডোনাল্ট ট্রাম্প জয় লাভ করছেন না, নির্বাচনের হাওয়া দেখে নিজেই বুঝে গিয়েছেন তিনি। নির্বাচনের ফলাফল যদি তার পক্ষে না হয়, মেনে নিবেন না। ফল না মানার এমন ইঙ্গিতও তিনি করেছেন। নির্বাচনের আগে একজন হেভিওয়েট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কি করে পারেন এমন মন্তব্য করতে? যার সমালোচনায় ওবামা স্বয়ং বিরক্ত হয়ে বলেছেন, নির্বাচনের ফল কোনো হাসি-ঠাট্টার বিষয় নয়, ট্রাম্প মানুষের মনে নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে সন্দেহের বীজ বুনতে চাইছেন। শুধু তাই নয়, মিডিয়া তার প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করছেন এমন বিশ্বাস ও ধারণা থেকে ট্রাম্প ও তার জামাতা ‘ট্রাম্প টিভি’ খোলার প্রায় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এনেছেন।

হিলারি-ট্রাম্প সাপে নেউলে সম্পর্কও এখন দৃশ্যমান মিডিয়ার কারণে। হিলারির পরিবার, তার স্বামীর চরিত্র এসব নিয়েও কম কু-কথা হয়নি। বুধবারের টিভি বিতর্কের শুরু বা শেষেও একে অপরের সঙ্গে করমর্দন করেননি। ন্যূনতম সৌজন্যটুকুও দেখাবার প্রয়োজনবোধ করেননি কেউ কারোর প্রতি। ট্রাম্পের বক্তব্য, মন্তব্য বরাবরই আপত্তিকর ও অশ্লীলতাকে ইঙ্গিত করে। তৃতীয় বিতর্কে ট্রাম্প হিলারির দিকে ক্ষুব্ধ ও তীর্যক দৃষ্টি দিয়ে ‘ন্যাস্টি ওম্যান’ বলে মন্তব্য করেন। ঝড় ওঠে সমালোচনার। ‘ন্যাস্টি ওম্যান’ টার্মটি এখন গর্বের, সম্মানের। টুইটারে হাজার হাজার নারী এখন নিজেদের মধ্যে সম্মানজনক সম্বোধন হিসেবে ন্যাস্টি ওম্যান- এই হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করছেন। প্রাক্তন ডেমোক্রেটিক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি হিলারিকে উদ্দেশ্য করে এক বার্তায় লিখেন, ‘এক জঘন্য মহিলা হিসেবে আরেক জঘন্য মহিলাকে বলছি, তুমি আমার অনুপ্রেরণা।’ আর হিলারির উদ্দেশ্যে ট্রাম্পের টুইট- ‘এক জঘন্য নারীর প্রতি আরেক জঘন্য নারী বলছে, তুমি আমাদের জন্য এক অনুপ্রেরণা।’

এই হচ্ছে মার্কিন নির্বাচনের পরিবেশ, প্রতিবেশ। নির্বাচনী প্রচারণার ধরন ও মান। একের প্রতি অন্যের বিদ্বেষ বচনের ফল্গুধারা দৃশ্যমান। যেখানে মিডিয়াকেও গাল দেওয়া হচ্ছে, অভিযোগের আঙুল তোলা হচ্ছে। উন্নত, উদার, আধুনিক বলে যারা দাবি করে, তাদের গ্রাম্যতা, নিচতা, হীনতা কতটা খাদে নামতে পারে তা এ প্রচারণা না দেখলে উপায় নেয় টের পাওয়ার। এতে আর যাই থাকুক সুষ্ঠু, গণতান্ত্রিক আচরণ ও শিষ্টাচার যে নেই, সন্দেহ নেই তাতে কোনো।  অমন পুরুষতান্ত্রিক প্রচারণাও বিরল বলা চলে। সাম্প্রদায়িকতাও রয়েছে ভেতরে ভেতরে। তবু তাদের মহৎ ও মহান ভাবতে ভালো লাগে আমাদের অনেকেরই।

অনেকেই আমাদের নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে বলেন, বকেন, সমালোচনা করেন। আমাদের নির্বাচনে এমন অশিষ্টাচার নেই, অশোভন আচরণ নেই, নেই এক্ট্রিম নোংরামি। ন্যূনতম সৌজন্য, সৌন্দর্য, শিষ্টাচার, সৌহার্দ্যটুকু আছে অন্যের প্রতি। আছে মানুষের জন্য সত্যিকারের স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসা, প্রেম। এই নির্বাচনের প্রচারণা বলতে বাধ্য করছে, অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ আমেরিকার চেয়ে ভালো।

লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্ট্রার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম এন্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।