টেকসই চাইনিজ যানজট


প্রকাশিত: ১০:০০ এএম, ১৫ অক্টোবর ২০১৬

‘প্রিয় ইন্দিরা, তুমি বিমানের জানালায় বসে,
গুজরাটের বন্যা দেখতে যেও না
এ বড় ভয়ঙ্কর খেলা
.......
আমি তোমাকে আবার সাবধান করে দিচ্ছি-
উঁচু থেকে তুমি দেখতে পাও মাইল মাইল শূন্যতা
প্রকৃতির নিয়ম ও নিয়মহীনতার সর্বনাশা মহিমা
নতুন জলের প্রবাহ, তেজে স্রোত- যেন মেঘলা আকাশ উল্টো
হয়ে শুয়ে আছে পৃথিবীতে
মাঝে মাঝে দ্বীপের মতন বাড়িও কান্ডহীন গাছের পল­বিত মাথা
ইন্দিরা, তখন সেই বন্যার দৃশ্য দেখেও একদিন তোমার মুখ ফস্কে
বেরিয়ে যেতে পারে, বাঃ, কী সুন্দর!’

গতকাল (শুক্রবার) সন্ধ্যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘ইন্ধিরা গান্ধীর প্রতি’ শিরোনামের এ কবিতাটি মনে পড়ছিল। কারওয়ানবাজারে আমাদের অফিসের আট তলার নিউজরুম থেকে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউর অনেকটাই দেখা যায়, কারওয়ানবাজার থেকে প্রায় শেরাটন মোড় পর্যন্ত। চীনের প্রেসিডেন্ট বঙ্গভবনে যাবেন বলে শুক্রবার সন্ধ্যায় রাস্তা ফাঁকা করে দেয়া হয়। ফাঁকা মানে ফাঁকা, রাস্তায় যেন পিঁপড়াও নেই। রাতের ঝলমলে আলোয় নজরুল ইসলাম এভিনিউকে লাগছিল মোহনীয়। আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, ‘বাঃ, কী সুন্দর!’ ফাঁকা রাস্তার সুবিধা নিয়ে দ্রুত বাসায় চলে যাবো, এই ভরসায় নিচে নেমেই পড়লাম যানজটে। যানজট শব্দটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। তবে এই যানজট নিত্য যানজটের মত নয়। নেমেই বুঝলাম, এই সুন্দরের পেছনে কতটা ভোগান্তি লুকিয়ে আছে।

তিন দশক পর কোনো চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর অবশ্যই ঐতিহাসিক। এই সফর উপলক্ষে ঢাকার জনগণ যে যানজট দেখলো, তাও ঐতিহাসিক। ভাগ্য ভালো দিনটি ছিল শুক্রবার, ছুটির দিন। তাতেই যে অবস্থা হয়েছে, ওয়ার্কিং ডে হলে কী হতো, ভাবতেই ভয় লাগছিল। চীনের রাষ্ট্রপতি ঢাকা সফরকালে লা মেরিডিয়ানে ছিলেন। তাই শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে শনিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত বিমানবন্দর রোডের একটা বড় অংশের এক পাশ বন্ধ থাকবে, এটা ডিএমপি আগেই ঘোষণা দিয়েছিল। সে ঘোষণাও বহুল প্রচারিত ছিল না। তবে বহুল প্রচারিত হলেও লাভ হতো না। কারণ ঘোষণার সাথে বাস্তবের মিল ছিল সামান্যই। এক পাশ নয়, দিনের একটা বড় সময় বিমানবন্দর রোড পুরোটাই বন্ধ ছিল। শুধু তাই নয়, শি জিন পিংয়ের আসা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাওয়া, বঙ্গভবন যাওয়া, সাভার যাওয়া এবং ফিরে যাওয়ার সময় রাস্তা বন্ধ ছিল দীর্ঘ সময়ের জন্য। এমনিতে ঢাকায় ভিভিআইপি চলাচলের সময় রাস্তার এক পাশ বন্ধ থাকে। আর রাস্তা বন্ধ করা হয় ভিভিআইপি চলাচলের আধঘণ্টা আগে। কিন্তু চীনা রাষ্ট্রপতির চলাচলের ক্ষেত্রে আগের সব নিয়ম ছাড়িয়ে যাওয়া হয়। অন্য এলাকার কথা জানি না, শুক্রবার সন্ধ্যায় চীনা প্রেসিডেন্টের বঙ্গভবনে যাওয়ার সময় দুই ঘণ্টারও বেশি সময় রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। লা মেরিডিয়ান থেকে বঙ্গভবন পর্যন্ত বিশাল সড়ক দুই ঘণ্টারও বেশি সময় বন্ধ থাকায় যানজট ছড়িয়ে পড়ে গোটা রাজধানীতে। বাসায় ফিরতে কারো চার ঘণ্টা লেগেছে, কারো তারচেয়ে বেশি।

বিমানবন্দর শুধু বিমানবন্দরে যাওয়ার রাস্তা নয়। এটা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কও। গাজীপুর ও ময়মনসিংহ জেলা একদিন কার্যত রাজধানী থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। উত্তরাবাসী বন্দি ছিল। ছুটির দিনে যারা ঘরে ছিলেন তারা ভালোই ছিলেন। কিন্তু যাদের ঘর থেকে বেরুতেই হয়েছিল, তারা নিজেদের সিদ্ধান্তকেই অভিশাপ দিয়েছেন। ঢাকার রাস্তায় শুক্রবার দিনভর আর শনিবার সকালে কত যে বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটেছে তার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। সফর যেমন ঐতিহাসিক, ভোগান্তিও হয়েছে ঐতিহাসিক। কারণ যানজটের প্রস্তুতি নিয়ে কেউ ঘর থেকে বের হয়নি।

অ্যাম্বুলেন্সের আর্তনাদে অসহায় ছিল পুলিশও। একজন ট্রাফিক পুলিশ বললেন, ডিউটিতে আসতে তাকেও কয়েক কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছে। জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট মিস, ফ্লাইট মিস করার মত ঘটনাও ঘটেছে। শুক্রবার বিয়ের দাওয়াত খেতে রওয়না দিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়া গাড়ি ঠেলে নেয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতাও জমা পড়েছে কারো কারো ঝুলিতে। কত হাজার মানুষ গন্তব্যে পৌঁছতে গাড়ি ফেলে মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। রাতে বাসায় যাওয়ার সময় ফার্মগেটে কয়েক হাজার লোককে অপেক্ষা করতে দেখেছি। তারা কীভাবে বাড়ি ফিরেছেন, কখন ফিরেছেন; কে জানে? যানজটে আটকে থাকতে থাকতে সাধারণ মানুষ যে ভাষায় নীতিনির্ধারকদের সম্বোধন করেছে, তা শুনতে ওনাদের কেমন লাগতো জানি না, আমার নিজেরই লেগেছে। সবচেয়ে ভদ্র ভাষা ছিল, ভোটের সময় আইসেন, দিমুনে...। শুনে আমি হেসেছি। আহারে শোধ নেয়ার কী দীর্ঘমেয়াদি আকাঙ্খা!

চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। আঞ্চলিক রাজনীতির স্বার্থেও চীন আমাদের বড় সহযোগী। তাই চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তার নিরাপত্তাও অবশ্যই টপ প্রায়োরিটি। কিন্তু তার মুভমেন্টের জন্য দুই ঘণ্টা রাস্তা বন্ধ করে রাখাটা অবশ্যই বাড়াবাড়ি। শি জিন পিং প্রায় ২৪ ঘণ্টা ঢাকায় ছিলেন। যদি এমন হতো তিনি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যানজটও বিদায় নিয়েছে বা নেবে, তাহলে আমাদের আপত্তি ছিল না। চীনের বানানো পণ্য টেকসই হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের যানজট টেকসই এবং দীর্ঘস্থায়ী। চীনের প্রেসিডেন্টের সফরের সময় যানজট না হয় একটু বেশি হয়েছে। কিন্তু আমাদের নিত্য যানজটের ভোগান্তিও কম নয়।

ঢাকায় মানুষ বেশি, রাস্তা কম। আর প্রতিদিন বাড়ছে যানবাহন। সিএনজিতে গাড়ি চালানোর সুবিধা পাওয়ার পর মধ্যবিত্তরাও লোন টোন করে একটা গাড়ি কিনে ফেলে। তাই ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ছেই। আর বাংলাদেশের সবকিছুই কেন্দ্রীভূত হওয়ায় রাজধানীর ওপর চাপও বাড়ছেই। তাই ঢাকায় যানজট হওয়ার আলাদা কোনো কারণ লাগে না। তবে মাঝে মধ্যে ঢাকা বদলে যায় নরকে। এই যেমন গত শুক্রবার। সবসময়ই ঢাকায় রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর মুভমেন্টে অসহনীয় যানজটের সৃষ্টি হয়। অসহনীয় লিখছি বটে, কিন্তু আমরা তো সহ্য করে নিয়েছি, মেনে নিয়েছি। যানজটে কত কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, তাতে কত ক্ষতি হয়, কেউ কি এই গবেষণা করেছেন?

যানজট নিরসনের কোনো ম্যাজিক নেই। রাস্তা বাড়াতে হবে, গাড়ি কমাতে হবে। গাড়ি কমালে কি মানুষ হেঁটে গন্তব্যে যাবে? ব্যক্তিগত গাড়ি কমাতে হবে, আর বাড়াতে হবে পাবলিক যান। শি জিন পিংয়ের সফরের সময় উত্তরার চালাক অধিবাসীরা ট্রেন ব্যবহার করে শহরে এসেছেন। এটা যদি তারা নিয়মিত করেন, তাহলে যানজট কিছুটা হলেও কমবে। আর ব্যক্তিগত গাড়ি কমানোর অনেকগুলো উপায় করা যায়। প্রথম কথা হলো, ব্যক্তিগত গাড়ির দাম বাড়িয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগত গাড়িতে সিএনজি ব্যবহার প্রথমে সীমিত করতে হবে, পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ জ্বালানি খরচ কম বলে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। আর ব্যস্ত সময়ে শহরের ব্যস্ত এলাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি প্রবেশের জন্য করারোপ করতে হবে। তবে এসবই টোটকা। যানজট নিরসনে চাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।

আগেই বলেছি শহরের অস্বাভাবিক যানজটের মূল কারণ, ভিভিআইপি চলাচল। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দায় অনেকটাই। তাই নগরবাসীর চলাচল নির্বিঘ্ন করতে প্রধানমন্ত্রীর চলাচল সীমিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুবই ডায়নামিক। উনি সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকেন। উনি প্রতি সপ্তাহে মন্ত্রিসভার বৈঠক করেন সচিবালয়ে। মাঝে মাঝে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে যান। মাঝে মাঝে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে যান বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। বিদেশ থেকে ফিরে নিয়ম করে রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করতে বঙ্গভবনে যান। বঙ্গভবনে যাওয়া ছাড়া প্রধানমন্ত্রী যদি তাঁর সব অনুষ্ঠান গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সীমিত রাখেন তাহলে নগরবাসীর দোয়া পাবেন তিনি। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে যানজট নিরসন না হওয়া পর্যন্ত আপাতত এই পরামর্শগুলো বাস্তবায়ন করলে তবু ঢাকা কিছুটা বাসযোগ্য থাকবে।

probash-amin

এইচআর/এবিএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।