বাঙালির একান্ত আপন শারদীয় উৎসব
শরতের নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘের ভেলা, আশ্বিনের কাশবন, গ্রাম গ্রামান্তরে ঢাকের আওয়াজ বলে দেয় উৎসব সমাগত। এ উৎসব হেমন্তে ফসল তোলার সঙ্গে জড়িত, এ উৎসব আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজের ঐতিহ্য ধরে রাখা মাতৃদেবীর আরাধনার উৎসব। প্রাচীন গ্রিস ও রোমে ধরিত্রী, ফসল ও প্রজননের দেবী, যুদ্ধের দেবী এবং সর্বোপরি মাতৃদেবীরূপে প্রচলিত ছিল নারী শক্তির পূজা। রিয়া, গেইয়া, দিমিতির, পার্সিফোনে, ভিনাস, আ্যাথেনি সবাই ভিন্ন ভিন্ন রূপে নারীর শক্তির ও উর্বরতার প্রতীক।
প্রাচীন মিশর, সুমেরিয়া, ব্যাবিলনিয়াতেও প্রচলিত ছিল মাতৃদেবীর পূজা। আইসিস, ইশতারের মতো দেবীরা ছিলেন প্রাচীন মানব সমাজের প্রধান উপাস্য। প্রকৃতির অপরিমেয় শক্তি এবং নারীর সন্তানজন্মদানের ক্ষমতা ছিল আদিম মানবসমাজের বিস্ময়। তাই প্রাচীন সমাজগুলোতে মাতৃদেবীর পূজাই ছিল প্রধান। দেবীদের মাহাত্ম্যসূচক পৌরাণিক আখ্যানগুলো মাতৃতন্ত্রের অবশেষরূপে সমাজে টিকে ছিল বহুকাল। পরবর্তিতে পুরুষতন্ত্র যত শক্তিশালী হয়েছে তত পুরুষদেবতারা ক্ষমতা লাভ করেছেন এবং প্রধান দেবীরা চলে গেছেন দ্বিতীয় অবস্থানে, কখনও প্রধান পুরুষদেবের স্ত্রী, কখনও কন্যারূপে। সুমেরিয়া, মিশর, গ্রিস, প্রাচীন ভারত-সর্বত্রই এটি ঘটেছে।
বাংলাদেশের আদিম সমাজ যে মাতৃতান্ত্রিক ছিল তার ঐতিহ্য আজও প্রবাহিত রয়েছে পরম শক্তিকে নারীরূপে কল্পনা করে তার উপাসনার মধ্য দিয়ে। দুর্গা, কালী, চণ্ডী, লক্ষ্মী, ভগবতী, ধূমাবতী, কমলা, সরস্বতী, বিশালাক্ষ্মী, মনসা, ঢাকেশ্বরী, বনদেবীসহ বিভিন্ন রূপে কখনও স্থানীয় পর্যায়ে কখনও বৃহত্তর পরিসরে পূজিত হয়েছেন মাতৃদেবীরা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী যেখানে কোমল, ক্ষমতাহীন যৌনতার প্রতীক সেখানে ‘শক্তি রূপেন সংস্থিতা’ দেবী দুর্গার মহিষাসুরমর্দিনী প্রতিমা স্মরণ করিয়ে দেয় আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজের নারী নেতৃত্বের কথা।
দেবী দুর্গার পূজা মূলত বাঙালিদের একান্ত আপন মাতৃদেবীর পূজা। দুর্গা আদ্যাশক্তি মহামায়া এবং নারীরূপে বিশ্বের পরম শক্তির প্রকাশ। দেবী পূজার মূল উৎস হচ্ছে সনাতন ধর্মের আদি শাস্ত্র বেদ। অভৃশ্য ঋষির কন্যা ব্রহ্মবাদিনী বাক সর্বপ্রথম তার অতীন্দ্র ধ্যাননেত্রে আবিষ্কার করেন দেবীসূক্ত। এই দেবীসূক্তই হচ্ছে মাতৃবন্দনার মঙ্গলসূত্র। তার মানে দেবীসূক্তের আবিষ্কারও করেন একজন নারী।
পুরাণ অনুসারে রাজ্যহারা রাজা সুরথ রাজ্য ফিরে পাবার জন্য বসন্তকালে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন। তাই এ পূজার নাম হয় ‘বাসন্তীপুজা’। এই উপাখ্যান রয়েছে চণ্ডীতে। রামচন্দ্র রাবণবধের জন্য শরৎকালে দেবীর পূজা করেন। অকালে পূজা করেন বলে এর নাম হয় ‘অকালবোধন’। শারদীয়া দুর্গাপূজাই তখন থেকে বেশি প্রচলিত হয়। তবে রামচন্দ্রের এই দুর্গাপূজার কথা বাল্মিকীর মূল রামায়ণে নেই। বাঙালি কবি কৃত্তিবাস যখন রামায়ণ নিজস্ব ভাষ্যে পরিবেশন করেন তখন তিনি এই উপাখ্যানটি যোগ করেন। দেবী দুর্গার উপাখ্যান পাওয়া যায় ‘দেবী ভাগবত’, ‘মার্কণ্ডেয় চণ্ডী’ ও ‘কালিকাপুরাণ’ ‘কালীবিলাসতন্ত্র’, ‘মহাভাগবত’, ‘বৃহন্নন্দিকেশ্বরপুরাণ’, ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী’, ‘দুর্গোৎসববিবেক’, ‘দুর্গোৎসবতত্ত্ব’ ইত্যাদি বইতে।
রাজাহারা যুধিষ্ঠির বিপদনাশ ও রাজ্য ফিরে পাবার জন্য দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন বলে মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে। সবগুলো ক্ষেত্রেই দেখা যায় যুদ্ধ জয় করার জন্য ও বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য দেবীর পূজা হয়েছে, দেবী দুর্গা জয়প্রদায়নকারী ও দুর্গতিনাশিনী। আশ্বিনের শুক্লাষষ্ঠী থেকে শুক্লানবমী পর্যন্ত দেবী দুর্গার পূজা হয়ে থাকে। দেবীর সঙ্গে যুক্ত হন আসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্যাবিজ্ঞানদায়িনী দেবী সরস্বতী, সর্বৈশ্বর্য প্রদায়িনী দেবী লক্ষ্মী, সর্বসিদ্ধিদাতা গণেশ, বলরূপী কার্তিক এবং ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন ত্যাগ ও বৈরাগ্যের প্রতীক মহাদেব। ফলে একই সঙ্গে শক্তি, জ্ঞান, ঐশ্বর্য, সিদ্ধি, বল ও বৈরাগ্যের সমাবেশ হয়।
ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে শক্তিদেবী হিসেবে বিভিন্ন নামে দুর্গা পূজা প্রচলিত থাকলেও বাংলাদেশে যে দেবী পূজিত হন তিনি আসেন সপরিবারে। পুত্র,কন্যা, স্বামীসহ যে দেবী দুর্গার পূজা এটি একান্তভাবে বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্য। লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেষ, মহাদেব, সিংহ ও অসুরসহ এমন প্রতিমা বাংলার(বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গ) বাইরে আর কোথাও দেখা যায় না। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এই প্রতিমা শুধু বাঙালির উৎসবেই দেখা যায়। বাঙালির ঘরের দেবী উমা বাঙালি নারীর কোমল, গার্হস্থ্য মাতৃরূপের প্রতীক যিনি স্বামী, সন্তানসহ পিতৃগৃহে এসেছেন কিছুদিনের জন্য। বিজয়া দশমীতে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দেবী আবার ফিরে যান স্বামীর ঘরে। বাঙালি মায়ের কল্যাণময়ী, স্নেহময়ী রূপেই জগজ্জননী দুর্গার আরাধনা করা হয়। তিনি একই সঙ্গে অসুরবিনাশী, অস্ত্রধারী আবার কোমল ও স্নিগ্ধ।
দুর্গাপূজা সকলের কারণ সববর্ণের মানুষ এ পূজায় অংশ নিতে পারে। দেবীকে স্নান করাতে যে বিভিন্নপ্রকার মাটির প্রয়োজন হয় তার মধ্যে এমনকি বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকাও রয়েছে। এর অর্থ সমাজের সকল শ্রেণির সকল স্তরের সকল পেশার মানুষ যেন এখানে অংশ নিতে পারে তা নিশ্চিত করা। দুর্গাপূজা যেমন হতে পারে কোনো পরিবারের বা ব্যক্তিগত, তেমনি হতে পারে বারোয়ারি বা সর্বজনীন। তারমানে সমাজের বিভিন্নশ্রেণির মানুষ সমষ্টিগতভাবে এ পূজা করতে পারে। আর বাংলাদেশে পুজা মণ্ডপে তো যেতে দেখা যায় সব ধর্মের মানুষকেই।
অন্যধর্মের মানুষরা পূজার উদ্দেশ্যে মণ্ডপে যান না বটে, কিন্তু উৎসবে অংশ নেওয়ার সামাজিক প্রেরণা থেকেই তারা যান নিঃসন্দেহে। পরমত ও পরধর্ম সহিষ্ণুতা আমাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। বাঙালির মুখেই প্রথম উচ্চারিত হয়েছে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। বাংলাদেশের সব ধর্মের মানুষ যেমন ঈদের ও মহরমের মেলায় আনন্দ করে তেমনি শারদীয় উৎসবের দশোহরা মেলায়, চড়কে কিংবা বারুণীর মেলায়, রাস পূণির্মায়, দোলোৎসবে অংশ নেন।
একালের সবচেয়ে সুন্দর যে কথাটি সর্বত্র প্রচলিত হয়েছে সেটি হলো- ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার।’ ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবগুলোর সময় মানুষের উপর যে হামলার ঘটনা ও অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো ঘটে তা বাঙালির চিরন্তন সহিষ্ণুতার ঐতিহ্যের পরিপন্থী ও সাংঘর্ষিক। এগুলো আমাদের ঐতিহ্যের মূলধারা নয়|। আমাদের ঐতিহ্য হলো বৈষ্ণব ও সুফীবাদ, নাথপন্থা, বাউলদের মানবপ্রেমের ও সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শ| আমরা নিজের নিজের ধর্মে নিষ্ঠাবান হয়েও সকল ধর্মকে সম্মান করার ঐতিহ্যকে ধারণ করি। শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালির সামাজিক উৎসব। এ উৎসব মিশে আছে শরতের শিউলি আর ছাতিম ফুলের সৌরভে, কাশবনের শুভ্রতায়, শারদীয় আকাশের নীলে।
বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে এই উৎসবের। তবে দেবী দুর্গা নিত্য বিরাজমান। মানব মনের ভিতরে যে অসুর বাস করে তার বিনাশ করার মাধ্যমেই মহাশক্তির জয়। জ্ঞান,বিদ্যা, মানসিক ঐশ্বর্য, বল ও বৈরাগ্যের মাধ্যমেই অসুরকে বিনাশ করে জগতের দুর্গতিনাশ করা সম্ভব। দুর্গোৎসব এই অসুর বিনাশের প্রতীক। শিশু ও নারীর বিরুদ্ধে হিংস্র থাবা মেলে ধেয়ে আসা অসুরকে বিনাশ করেই সার্থক হোক দুর্গোৎসব। নারীর উপর নির্যাতনকারী অসুররূপ অপশক্তির বিরুদ্ধে জয়ী হোক শুভশক্তি। প্রতিমা বিসর্জন হোক কিন্তু সকল বাঙালি নারীর মধ্যে জেগে উঠুক অসুরবিনাশিনীর পরমশক্তি।
লেখক : কবি, সাংবাদিক
এইচআর/এবিএস