খাদিজা, জেগে ওঠো বোন আমার

হাবীবাহ্ নাসরীন
হাবীবাহ্ নাসরীন হাবীবাহ্ নাসরীন , কবি ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৬:৫৪ এএম, ০৬ অক্টোবর ২০১৬

প্রত্যেকটা মুহূর্ত এই মুহূর্তে দুশ্চিন্তার। যখন লিখতে শুরু করেছি, আমি জানি না, খাদিজা বেঁচে আছে কি না। হাসপাতালের মৃত্যু মৃত্যু গন্ধের ভেতর হাজারটা অপরিচিত যন্ত্রপাতির সঙ্গে শুয়ে আছে যে মেয়েটি, মাত্র তিনটি দিন আগেও সে এরকম ছিল না। তার তো এমন থাকবার কথা ছিল না। তার পরীক্ষা ছিল। মেয়েটি আগের রাতে রাত জেগে পড়তে গিয়ে হয়তো মায়ের বকুনিও খেয়েছিল, ‘আর রাত জাগতে হবে না খাদিজা, সকালেই না পরীক্ষা!’ সেই খাদিজাই এখন মায়ের কোল ছেড়ে, ভাইবোনের খুনসুটি ছেড়ে একলা একা শুয়ে আছে। মা জানে না, খাদিজা ফিরবে কি না, ভিনদেশে বসে বাবা কেঁদে চোখের জলে গা ভেজাচ্ছেন, যার বুকের মানিক হারায়, সে ছাড়া আর কে বুঝবে এই যন্ত্রণা!

খাদিজার ওপর হামলাকারী যে ছেলেটি, বদরুল, অনেকেই তাকে নরপশু, অমানুষ নামে আখ্যায়িত করছেন। বদরুলকে ঘৃণা করা যায়। সে ঘৃণা পাওয়ারই উপযুক্ত। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো আমরা সবাই বদরুলকে ঘৃণা করলেও এই হিংস্র ও অমানুষ বদরুলকে গড়ে উঠতে যে সমাজব্যবস্থা, যে অসুস্থ রাজনীতি, যে নীতিহীনতা সাহায্য করেছে, সেসব কোনোকিছুই আমরা ঘৃণা করছি না। অথবা ঘৃণা করলেও প্রকাশ করতে পারছি না। আমরা চুপচাপ মেনে নিচ্ছি অথবা মানিয়ে নিচ্ছি। অসুস্থ রাজনীতির বলি হয়ে কত বদরুল যে অমানুষ হচ্ছে এবং কত খাদিজা যে অকালে ঝরে যাচ্ছে, সে হিসাবও কেউ রাখছি না। দেশের মানুষের গড় আয়ু হিসেব করলে প্রায় অর্ধেক জীবন শেষ হয়েছে বদরুলের। সে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। যেখানে পড়ার স্বপ্ন থাকে অনেকেরই। এমন একটি বৃহৎ পরিসরের শিক্ষার্থী হয়েও বদরুল যে মানুষ হতে পারলো না, সেই দায় কি শুধুই বদরুলের? রাজনৈতিক প্রশ্রয় ও নীতিহীনতা, সুশিক্ষার অভাব, পরিবারের ব্যর্থতা- এসব কি আজকের বদরুলকে তৈরি করেনি?

খাদিজাকে যখন মাটিতে ফেলে কোপানো হচ্ছিল, ভিডিওর কল্যাণে আমরা দেখলাম, সাত-আটজন কিংবা তারও বেশি সংখ্যায় মানুষ, তারা দৌড়ে পালিয়ে গেল! একটি চাপাতির সামনে একজন অথবা দুজন মানুষ অসহায় হতে পারে, তাই বলে সাত-আটজন? এ আর কিছু নয়, যে অসহায়ত্ব আমরা পুষে রাখছি দিনের পর দিন, তারই বহিপ্রকাশ। সাহসী হতে আমরা কোথা থেকে শিখবো? আমাদের নেত্রীরা এখন অচেতন খাদিজার সঙ্গে সেলফি সেলফি খেলায় মেতে ওঠেন! এমন মানসিকতার কেউ দেশের সাংসদ হলে, আইনের প্রণয়নকারী হলে সে দেশে তো ভিডিওবাজ প্রজন্মই গড়ে উঠবে! কেন শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জাতির পিতা শেখ মুজিব কিংবা মাওলানা ভাসানীর মতো নেতা আর আসে না? ব্যক্তিগত লোভের কাছে পরাজিত যেসব কাপুরুষ, তারাই এখন আমাদের দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। তাই আমরা বিড়ালের ভয়েই থরথরিয়ে কাঁপি, আর বাঘের গল্প শুনলে তো অজ্ঞান হয়ে যাই! মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর আগেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা নয় মাসের মরণপণ লড়াই শেষে স্বাধীন একটি ভূখণ্ড এনে দিয়েছেন। পূর্বপুরুষের সেই রক্তভেজা পবিত্র ভূমিকে আমরা এখন অপবিত্র করছি নিজেদের ভেতর হানাহানি আর কোন্দল করে, একে অন্যকে রক্তাক্ত করে! স্বাধীনতার এমন অসহ্য অপব্যবহার এর আগে কখনো কেউ কি করেছে!

যে বয়সে আমাদের জীবন গড়ার কথা, হাসি-আনন্দ-উচ্ছ্বলতা নিয়ে বেঁচে থাকার কথা, আমরা তখন নিজেরা তো মরছিই, অন্যকেও মেরে ফেলছি! রাজনীতির দোহাই দিয়ে আমরা যাদেরকে আক্রমণ করছি, তারা আমাদেরই ভাই, আমাদেরই বোন। আমাদের স্বাধীন ভূমিতে একদল দখলদারিত্বের অহম নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তো আরেকদল জীবন হাতে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কিছু বছর পরপর বদলাচ্ছে এই চিত্র। ‘ক্ষমতায় এলে আমরাও দেখিয়ে দেবো’- এই আক্রমণাত্মক ও প্রতিহিংসাপরায়ণ মানসিকতা থেকে আমরা কবে বের হবো? কেন আমরা নিজেদের মধ্যে হানাহানি করে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি? আমাদের পূর্বপুরুষেরা কি এজন্যই নিজেদের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন!

আমাদের মানবাধিকারকর্মী এবং নারীবাদীরা নারীর শরীরের স্বাধীনতা আদায়ে এতটাই মশগুল যে আর কোনোদিকে তাদের খেয়াল নেই। প্রাণ না থাকলে শরীর যে কোনো কাজে আসবে না, একথা তাদের মনেই পড়ে না। পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের শিক্ষা দেয় না নারীকে সম্মান করার, মানুষকে ভালোবাসার। ব্যক্তিগত স্বার্থই যেন আজ একমাত্র সত্য ও আরাধ্য। এদেশে মরে না গেলে বিচার পাওয়া প্রায় অসম্ভব। মৃত্যুও সবক্ষেত্রে বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করে না। বিচারহীনতাই আমাদের নিরাশ করছে বিচারপ্রাপ্তির প্রত্যাশা থেকে। এর আগের প্রত্যেকটা খুনের যদি বিচার মিলতো, তবে বদরুলরা গড়ে উঠতো না। খুনিরা প্রশ্রয় পেলে আরো অনেক খুন করে বেড়াবে, এটাই কি স্বাভাবিক নয়? তাই প্রত্যেকবার আমরা বিচারের জন্য আন্দোলন করি, মানববন্ধন করি, প্লাকার্ড গলায় ঝুলাই। এ পর্যন্তই। শেষমেশ তনুদের জায়গা হয় ঝালমুড়ির ঠোঙায়। এমনি করেই বুঝি হারিয়ে যাবে আমাদের সম্ভাবনাময় প্রজন্ম! ভালোবাসাহীন, স্বার্থপর ও লোভী একটি জাতির ধ্বংস হতে আর কতদিনই বা লাগে!

আমি এখনও জানি না, খাদিজা বেঁচে আছে কি না, আদৌ বেঁচে থাকবে কি না! খাদিজা, তুমি ফিরে এসো বোন, অমানুষের কাছে হার মেনো না। সব আশঙ্কা, সব ভয়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তুমি আবার জেগে ওঠো বোন আমার। আমরা ঘুরে দাঁড়াতে চাই। আমরা আমাদের মূল্যবান জীবনটাকে অমানুষদের ভয়ে শেষ করে দিতে চাই না। তুমি ফিরে এলে একটি ভালোবাসাময় পৃথিবী গড়ে তুলবো আমরা, কথা দিলাম। ফিরে এসো বোন আমার, ঘুরে দাঁড়ানোর শুরুটা তোমাকে দিয়েই হোক!

লেখক : সাংবাদিক

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।