বাবা করেছেন বিয়ে আবার মা করছেন লিভ টুগেদার


প্রকাশিত: ০৩:৫৩ এএম, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

জ্ঞান-বুদ্ধি হবার পর থেকেই পরিবারের একমাত্র সন্তান মনিরুল (ছদ্মনাম) দেখে আসছে তার বাবা-মায়ের দাম্পত্য কলহ। সামান্য বিষয় থেকে শুরু হয়ে অনেক বড় আকার ধারণ করতো। পাড়ার সকল মানুষ জড়ো হয়ে উপভোগ করত মনিরুলের বাবা-মায়ের সেই ঝগড়া, অভিযোগ, গালাগালি ইত্যাদি ইত্যাদি। আর শিশু মনিরুল ঘরের মধ্যে বসে দেখতো তার বাবা-মায়ের সব কাণ্ড-কারখানা। বিকেলে মাঠে খেলতে গেলে পাগলের ছেলে, এই কথা বলে পাড়ার সকলে মিলে ক্ষ্যাপাতো। কাউকে বলতেও পারতো না। মাঠের কোণে বসে  কাঁদতো ছোট্ট সেই শিশুটি।

মনিরুলের সেই কষ্ট বুঝবার কেউ ছিল না। আদর করে মা  খেতেও ডাকতো না। বাবা কোলেও নিত না। তারা তাদের সমস্যা নিয়েই অনেক ব্যস্ত থাকত। আত্মীয় স্বজন শালিস-বিচার করতো দিন রাত সর্বক্ষণ। এর মাঝে থেকেই মনিরুল বড় হতে থাকে। লেখাপড়াসহ অন্যান্য কারণে মনিরুল প্রায় সময়ই বাড়ির বাইরে থাকার চেষ্টা করতো। জীবনে কখনো একসাথে বাবা-মায়ের হাত ধরে হাঁটার সুযোগ পায়নি। এক বালিশে বাবা-মাকে দুই পাশে নিয়ে মাঝখানে ঘুমানোর সাধ কখনও পূরণ হয়নি। শুধু বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখেই বড় হয়েছে।

মনিরুল এখন চাকরি করে। বিদেশি কোম্পানি এবং ভালো পদে চাকরি হওয়ায় তার বেতনও অনেক বেশি। অনেকদিন থেকেই সংসারের সকল খরচ একাই বহন করে আসছে। এখনও সন্ধ্যার সময় যখন অফিস থেকে বাড়ি আসে, বাবা-মা একজন অন্যজন সম্পর্কে নানা অভিযোগ হাজির করে মনিরুলের কাছে। তার কাছে নিরপেক্ষ বিচার দাবি করে। সন্তান কিভাবে বাবা-মায়ের বিচার করবে? একটিবারও এই বাবা-মা বোঝে না, যে ছেলেটি সারাদিন গাধার খাটুনি খেটে ঘরে এসেছে, তার একটু বিশ্রাম দরকার। সন্ধ্যার পর আবার মনিরুল বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। অনেক সময় সহকর্মীর বাড়িতে বিশ্রাম নেয়। রাত দশটার পর বাড়িতে আসে। শুক্রবার বন্ধের দিন যে একটু বেশি ঘুমাবে, সে সুযোগও হয় না। খুব সকালে বাবা-মায়ের চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে যায়। এভাবেই চলছে মনিরুলের প্রতিদিনের রুটিন জীবন।

দুই.
“খোকন এখন হোস্টেলে থাকে রঙ্গিন পৃথিবী কালো
বাবা করেছেন বিয়ে আবার মা করেছেন লিভ টুগেদার
খোকন ছাড়া মোটামুটি আর সবাই রয়েছেন ভালো
দুটো পাড় যদি এক হতে না চায়, সেতুর কি প্রয়োজন?”

নচিকেতার এই ‘খোকন’ শিরোনামের গানটি অনেকেই শুনে থাকবেন। ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গানটি যেমন আমাদের অশ্রুসিক্ত করে, ‘খোকন’ গানটিও যারা শুনেছেন তাদের অনেকের মধ্যে কিছুটা হাহাকার দেখা গেছে। তবে বিষয়টা সেভাবে প্রকাশ পায়নি। সময় এখন সত্যিই বদলে গেছে। একটা সময়ে দেখা যেত, সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বাবা-মা অনেক কিছু সহ্য করতো। তবে ক্রমেই যেন পরিস্থিতি পাল্টে যাচ্ছে। সদ্যোজাত সন্তানকে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া হচ্ছে, এমন মা-বাবা আমাদের সমাজেই আছে।

তিন.
আমরা সবসময় বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্বের কথা বলি। অবশ্যই বলা উচিত। আমার বিশ্বাস আমাদের দেশে অধিকাংশ সন্তানই তাদের বাবা-মায়ের প্রতি মোটামুটিভাবে দায়িত্ব পালন করে থাকে। পুরোপুরি দায়িত্ব পালন করে এমন সংখ্যা যেমন অনেক কম, ঠিক তেমনি একেবারেই কোনো দায়িত্ব পালন করে না, বৃদ্ধ বাবা-মায়ের খোঁজখবর নেয় না, সেই সংখ্যাও অনেক  কম। কিন্তু সন্তানের প্রতি কিছু বাবা-মায়ের অনাদর, অবহেলার কথা আমরা কখনও বলি না ।  আমরা ধরেই নিয়েছি শতভাগ বাবা-মা তাদের সন্তানের প্রতি পুরোপুরি দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু বিষয়টি আদৌ সেই অবস্থায় নেই। দাম্পত্য কলহের জেরে সন্তানের জীবন যে দুর্বিষহ হয়ে যায়, সে কথা কে বুঝাবে আমাদের বাবা-মায়েদের? মায়ের পরকীয়ার কারণে অবুঝ সন্তানকে হত্যা করা হচ্ছে। বাবার পরকীয়ার কারণে সন্তানকে শিশুসদনে রেখে আসা হচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় তারা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। আলাদা তারা হতেই পারে। কিন্তু একবারও ভাবছে না ঘরের ৬ মাস কিংবা ১ বছর বয়সী বাচ্চাটির কথা, তার ভবিষ্যতের কথা। শিশুটির তো কোনো দোষ ছিল না। অথচ সারাটি জীবন তাকে সকল ধরনের আদর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। শিশুটির বাবা-মা আবার নিজেদের মত সংসার গুছিয়ে নিচ্ছে। আর শিশুটি মানুষ হচ্ছে তার নানী কিংবা দাদির কাছে। অনেকেই আবার বাচ্চা দত্তক দিয়ে দিচ্ছে।

চার.
পেশাগত কারণে অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের সময় দিতে পারে না। অনেকে ব্যস্ততার কারণে সন্তান কি করে, কোথায় যায়, সামান্য খোঁজ খবরও নিতে পারে না। সকল বাবা-মায়ের মনে রাখা উচিত, আপনি যদি আপনার দায়িত্ব ঠিক মতো পালন না করেন, সন্তানের কাছ থেকে কিছু আশা করাও আপনার জন্য বোকামি হবে। অনেকেই উপহার দিয়ে সময় দিতে না পারার ঘাটতিটুকু পূরণ করতে চান। সন্তানকে সন্তুষ্ট রাখতে আপনি তাকে প্রতিদিনই নিত্যনতুন উপহার দিচ্ছেন। অনেকে আবার দামি দোকানের দামি খাবার খাওয়ানোকে সন্তানের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসার প্রকাশ বলে মনে করেন। এতে চাহিদা শুধু বাড়তেই থাকে। শুধু পেতেই সে অভ্যস্ত হয়ে যায়। আপনাদের প্রতি তার ভালোবাসা বাড়ে না। আপনাদের সন্তান ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবে, এমন কিছু করা থেকে অন্তত আমাদের প্রত্যেক বাবা-মাকে বিরত থাকা উচিত। সন্তানকে অন্য সব কিছুই দিয়েছেন, কিন্তু তার জন্যে সবচেয়ে জরুরি এবং প্রয়োজনীয় ‘সময়’ দেননি। সবকিছুই বৃথা।

পাঁচ.
দাম্পত্য কলহ থাকবে। কিন্তু তা যেন সন্তানের ওপর কোনো প্রভাব না ফেলে, সেই বিষয়ে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। সমস্যা বড় আকার ধারণ করার পূর্বে, নিজেরাই মিটিয়ে ফেলুন। আলোচনা করুন, সকল সমস্যার সমাধান সম্ভব। যে বয়সের জোরে আজ আপনারা বিভিন্ন কলহে লিপ্ত, একদিন শরীরের এই শক্তি, সামর্থ্য থাকবে না। সন্তানের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। সন্তানের প্রতি আপনাদের দায়িত্ব ঠিক মত পালন করুন। বাবা-মায়ের দাম্পত্য কলহ শিশুটির মানসিক বিকাশে যে কত বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তা বাবা-মায়ের অনুধাবন করা উচিত। বাবা-মায়ের অসচেতনতার কারণে অনেক সন্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন থেকে। প্রত্যেক বাবা-মায়ের নিজেদের অবস্থান থেকেই আত্মোপলব্ধি প্রয়োজন। কারণ একমাত্র বাবা-মা পারে তাদের সন্তানকে সকল অমঙ্গল থেকে রক্ষা করতে।

লেখকঃ  উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।