সচেতনতা নেই, পরিচ্ছন্নতা উধাও


প্রকাশিত: ০৫:৪৮ এএম, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

এবারের ঈদের সময়টা কর্মস্থান ঢাকা থেকে দূরে শ্রীমঙ্গলে কাটিয়ে এলাম। ভাইব্র্যান্ট বা কর্মচঞ্চল জীবন থেকে শান্ত শহরে বসে রাজধানীকে নিয়ে সব খারাপ কাজের শিরোনাম দেখছিলাম। সিটি কর্পোরেশনের আহ্বান শুনেনি নগরবাসী, কর্পোরেশনের নির্ধারিত স্থানে কোরবানির পশু নিয়ে যায়নি তারা, যত্রতত্র, রাস্তার উপরে কোরবানি হয়েছে, আর টানা বৃষ্টিতে পশুর রক্ত মিশে গিয়ে রক্তগঙ্গার ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

এমনিতেই সব খারাপ কাজের জন্য শিরোনামে থাকার শহর ঢাকা। নগরীর যেকোনো প্রান্তে কিছুক্ষণ থাকলেই বোঝা যায় যে এ শহরে প্রশাসন বলে কিছু নেই। যেখানে সেখানে বাজার, রাস্তা আর ফুটপাথ দখল করে টুল-টেবিল পেতে বসে ব্যবসা, চল্টা উঠা বাসের রেষারেষি, দিগভ্রান্ত হিউম্যান হলার এবং তার চালকের দাপাদাপি, হকারদের চাপাচাপি দেখলে মনে হয় ঢাকায় সব নির্বাচিত আর সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসকরা বোধহয় বেতনসমেত ছুটি কাটান এখানে আর বাস করেন অন্য দেশে।

রাস্তাগুলি যথেষ্ট প্রশস্ত, কিন্তু বাস, মিনিবাস, প্রাইভেট কার, সিএনজি আর রিকশা এমনভাবে দখল করে থাকে দিনভর যে দেখলে মনে হবে এ নগরীর রাস্তা একেবারে অপরিসর, দুর্গম, অগম্য। কোথাও কোথাও রাস্তার দু’পাশে আবর্জনাময় খোলা নর্দমা এই শহরের আর এক বিশেষত্ব। সব সম্পদ দিয়ে ঢাকার উন্নয়ন আর ঢাকাকেই ধ্যানজ্ঞান করে রাষ্ট্র চালাবার চেষ্টা সব সময় হয়েছে, এখনো হচ্ছে। কিন্তু তবুও ঢাকার পরিচয় জঞ্জালের শহর হিসেবেই।

শহরটা সুন্দর হোক সে তো সকলেই চায়। কিন্তু নিজে অন্তরের গহীন থেকে সেই চাওয়ার সাথে আচরণের মিল নেই। দুই নতুন মেয়রের চেষ্টা আছে, কাজও করছেন। কিন্তু আমরা নিজেরা কতটা নাগরিক হয়ে উঠছি সেটা এক বড় প্রশ্ন। রাজধানীকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার প্রাথমিক চেষ্টা হিসেবে দুই মেয়র প্রায় সব ফুটপাথে ট্র্যাস ক্যান বা ডাস্টবিন দিয়েছেন। এই নগরবাসী এমনই যে, সেগুলো হয় ভেঙে ফেলছে, নয়তো তার বাইরে ময়লা ফেলছে। তাই যে নগরীর মানুষ এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন তারাতো রাস্তায় ময়লা ফেলবে, কোরবানি করবে, রক্ত রেখে মাংস নিয়ে বাসায় গিয়ে আরামে খাবে আর শহরে রক্তগঙ্গার ছবি দেখবে ফেসবুকে আর টিভিতে। দেখবে আর কিছুটা আহ উহ করবে।

আমি যে পার্কে হাঁটি তার ভেতর কোনো খাবার নিয়ে প্র্রবেশ করা নিষেধ। কিন্তু পার্কের দেয়াল ঘেষে গড়ে উঠা দোকান আর চটপটি শপ থেকে কাউকে কাউকে দেখি রেলিং-এর ফাঁক গলিয়ে সেসব ভেতর নিয়ে এসে বসে খান, জায়গাটিতে ময়লা ফেলে একসময় উঠে চলে যান। যে মানুষ স্বাস্থ্য সচেতনতায় পার্কে আসেন, তারই আবার এমন অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস। এমনটাই যখন বাস্তবতা তখন আসলে কি করা যায়? রাস্তায় কিছু ফেললে অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন জরিমানার ব্যবস্থা চালু এখনই শুরু করতে হবে। রাস্তার ধারের গাছগুলোকে সুন্দর ভাবে একটা নির্দিষ্ট শেপে ছাঁটা যেতে পারে। আর একটা জরুরি কাজ হল, ব্যস্ত অঞ্চলে পর্যাপ্ত সংখ্যায় টয়লেট নির্মাণ।

ঈদে কতনা আলোর রোশনাই ছিল চারদিকে। এমনিতেও ঢাকায় আলোর কমতি নেই। কিন্তু আমরা জানি এই শহরের জোরালো আলোর পিছনে লুকিয়ে আছে আরও বেশি অন্ধকার। আমরা যারা অনেকদিন ধরে এই শহরে আছি তারা দেখছি চোখের সামনে কতখানি বদলে গেছে রাজধানী। চোখের সামনেই হারিয়ে গেছে মূল্যবোধ স্নেহ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসার স্পর্শ। জলাভূমি, বাড়ি, স্থাপনা প্রশাসনের অমনোযোগিতায় বা উৎসাহে অবাঞ্ছিতদের দখলে হারিয়েছে কত ঐতিহ্য, বনেদিয়ানা।

এখন চাকচিক্য হয়তো অনেক বেড়েছে। সকাল সন্ধ্যা পরিষ্কার হওয়া পথঘাট, নিয়মিত জঞ্জাল অপসারণ, আলোকস্তম্ভের জোরালো আলো, অনেক স্থানে, কোনো কোনো বিশেষ এলাকার সৌন্দর্য বাড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু রাজধানী ঢাকা তার সরলতার সৌন্দর্য হারিয়েছে।

সিটি কর্পোরেশন একটি থেকে দুটি হয়েছে। তাই দু’জন মেয়রও পেয়েছি আমরা। বেশ বড় কিছু সড়ক আর উড়াল সড়ক হয়েছে, রং বেরং-এর রেস্তোরাঁ হয়েছে, হোটেল হয়েছে। কিন্তু একি সাথে হাজারো আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকা ঢাকাকে ঢেকে ফেলেছে অনিয়মের জালে।

ড্রেনেজ ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে এই রক্তভরা জলের ছবিতে। তবে জলাবদ্ধতা কমেছেও অনেকখানি। তাই পানি সরতেও সময় লাগেনি দেখা গেলো। দুই মেয়র আর তাদের কর্মীদের নিরলস চেষ্টায় টন কে টন ময়লা সরানো সম্ভব হয়েছে দ্রুততার সাথে। সিটি কর্পোরেশনের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বেড়েছে, আরো বাড়াতে হবে। কিন্তু নাগরিক হিসেবে আমরা কি করছি?

এই নগরীকে পরিষ্কার রাখা শুধু কর্পোরেশনের, এমন ভাবনা ভয়ংকর। ডাস্টবিন থাকলেও আমরা নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলিনা, যত্রতত্র ময়লা ফেলে দুর্গন্ধ ছড়াই। চারদিকে বদগন্ধের জন্য সিটি কর্পোরেশনের দায় থাকলেও আমরা নিজেরাও কম দায়ী নই।

যত্রতত্র ছড়ানো পলিথিন, চিপস, বিস্কুটসহ বিভিন্ন পণ্যের মোড়ক, নর্দমায় জমে থাকা আবর্জনার স্তুপ, দেয়ালে, খাম্বায় পানের পিকের দাগ যেন নিমেষেই চুরমার করে দেয় রাজধানীর স্বচ্ছতা, পরিচ্ছন্নতাকে। সারা শহরে ফাস্ট ফুডের মিছিল, সব্জির বেচাকেনা। তখন মনে হয় দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে এই রাজধানী।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে টানিছে পশ্চাতে’। কিন্তু এ দেশে যারা এগিয়েছে অনেক, বিশেষ করে অর্থ বিত্তে তাদের আচরণও পেছনে টানছে রাজধানীকে। সুন্দর, সুরম্য অট্টালিকায় বাস করে এপার্টমেন্টের ব্যালকনি থেকে রাস্তায় ছুঁড়ে মারছে ঘরের আবর্জনা। এমন যাদের সংস্কৃতি তাদের জন্য হাজার ব্যবস্থাও কোন ফল আনবেনা। চাই আইন, আইনের প্রয়োগ আর জরিমানা করার সংস্কৃতি। মানুষ ঠিক হয় শৃঙ্খলায়। আর শৃঙ্খলার জন্য দরকার কঠোরতা।

syed-Ishtiaque-Reza

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।