চীনের সুখী পাণ্ডা আর বাংলার হতভাগ্য বাঘ


প্রকাশিত: ০৪:১০ এএম, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

প্রকৃতির দুই সুদর্শন সন্তান চীন দেশের পাণ্ডা আর বাংলার বাঘ। চীনদেশে থাকার সময় দেখেছি বাংলাদেশের নাম বললে চিনতে পারুক আর না পারুক বাংলার বাঘকে চেনে না এমন লোক বিরল। বাংলাদেশকে  চীনারা বলে মুনজালা। আর বাংলার বাঘের নাম মুনজালা হু। পাণ্ডা এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগার দুটি প্রাণীই বিলুপ্তির পথে।

পাণ্ডাকে সংরক্ষণ এবং পাণ্ডার বংশ বিস্তারের জন্য চীনাদের উদ্যোগ আয়োজনের অন্ত নেই। ছেংদুতে পাণ্ডা প্রজনন কেন্দ্রে পাণ্ডার প্রজনন বৃদ্ধির জন্য চলছে ব্যাপক গবেষণা এবং কার্যক্রম। শুধু তাই নয়, ছেংদুর এই গবেষণাকেন্দ্র  এবং অভয়ারণ্য সারা বিশ্বের পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। এখানে পাণ্ডা, বিশাল পার্ক, পাহাড় ও গবেষণা কেন্দ্র দেখতে প্রতিবছর লাখ লাখ পর্যটক আসেন বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে। ছেংদুর অর্থনীতি নতুন মাত্রা পেয়েছে এই পাণ্ডা প্রজনন কেন্দ্র স্থাপনের পর থেকে।

চীন সরকার পাণ্ডা বিক্রি করে না। বিভিন্ন দেশের চিড়িয়াখানায় যেসব পাণ্ডা দেখা যায় সেগুলো চীন সরকারের সম্পত্তি। বিপুল অংকের অর্থের বিনিময়ে এই পাণ্ডাদের কিছুদিনের জন্য পাঠানো হয় প্রবাসে। বিদেশি চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ পাণ্ডা রাখার জন্য চীন সরকারকে অর্থ প্রদান করে। ওই পাণ্ডার দেখাশোনার  জন্য চীন সরকার মনোনীত বিশেষ পরিচর্যাকারী নিযুক্ত হয়। ওই পাণ্ডার যদি কোনো শাবক হয় তাহলে সেগুলোও চীনের সম্পত্তি। পাণ্ডাকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং জনপ্রিয় করতে তথ্যচিত্র, ছবি, ভিডিও, অনলাইনে প্রচার কোনোটারই কমতি নেই।  চীনে পাণ্ডা পুতুল, পাণ্ডা চাবির রিং থেকে শুরু করে টিশার্ট, মগ, হেন জিনিস নেই যেখানে পাণ্ডার ছবি বা আই লাভ পাণ্ডা লেখা নেই।

পাণ্ডা নিয়ে এত কথা বললাম এই জন্য যে, যখনি আমি এগুলো দেখি তখনি আমার মনে পড়ে যায় বেচারা দুঃখী গরীব বাঘমামার কথা। আমাদের রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে সংরক্ষণের জন্য কী করেছি আমরা? চোরাই শিকার করে বাঘের গোষ্ঠি নাশ করেছি। চিড়িয়াখানায় রাখা বাঘের খাবার মেরে দিয়ে বাঘগুলোকে শুকিয়ে মেরেছি। বাঘের আবাস দখল করে ঘরবাড়ি বানিয়ে আর বনধ্বংস করে বাঘকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়েছি। বনে খাবার না পেয়ে বাঘ যখন খিদের জ্বালায় লোকালয়ে এসেছে তখন তাকে পিটিয়ে মেরেছি।

বাঘের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার জন্য রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ার উদ্যোগ নিয়েছি। ভাবতে অবাক লাগে, আমরা কত হতভাগ্য যে নিজেদের সম্পদ নিজেরা চিনি না। এবং নিজেদের সম্পদ নিজেরাই নষ্ট করি। বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির জন্য কি দেশের আর কোথাও জায়গা ছিল না যে, সুন্দরবন ধ্বংসের ঝুঁকি নিয়ে সেটি করতে হবে? অসংখ্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র সারা বিশ্বে রয়েছে কিন্তু সুন্দরবন তো অনন্য, তেমনি অনন্য বাংলার বাঘ। নরুনের জন্য নাক হারানো যে কত বড় বোকামো সেটা বোঝার মতো কি সংশ্লিষ্ট মহলে কেউ নেই?

অথচ এমনি একটি সুন্দরবন ও এমনি রয়েল বেঙ্গল যদি চীন কি অন্য উন্নত দেশে থাকতো? সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রেখে পর্যটনশিল্প থেকেই সহস্র কোটি টাকা উপার্জন করা যেত। বেঙ্গল টাইগারকে জনপ্রিয় করে আমরা কি পারতাম না পাণ্ডার মতো তাদের মাধ্যমে অর্থ আয় করতে? বাংলাদেশের খেলনার দোকানগুলোতে খোঁজ করে দেখুন তো বাঘের খেলনা ক’টি পাওয়া যায়? যে সফট টয়েজগুলো পাওয়া যায়, সেগুলোও আসে চীন থেকে। বাংলাদেশে আসা একজন বিদেশি যদি বাঘের ছবি, পুতুল ও অন্যান্য সুভেনির কিনতে চান তাহলে কি দেশের তৈরি উচ্চ মানসম্পন্ন খুব বেশি জিনিস পাবেন?

বেঙ্গল টাইগারের উপর তথ্যচিত্র ক’টি হয়েছে? পাণ্ডার কার্টুন আর পাণ্ডার ছোট ছোট ছবি ও ভিডিওতে ফেসবুক ভরপুর। বাঘের সেরকম নেই কেন? ছেংদুর বিখ্যাত পাণ্ডা প্রজনন কেন্দ্রের মতো খুলনায় বেঙ্গল টাইগার প্রজননের অত্যাধুনিক কেন্দ্র গড়ে তোলা যায় না? বাংলার বাঘ কি অন্য কোনো প্রাণীর চেয়ে কিছু কম সুন্দর? তাহলে তো পর্যটন শিল্প থেকেই প্রত্যাশার চেয়ে বেশি উপার্জন করা সম্ভব। বেইজিং চিড়িয়াখানায় দেখেছি পাণ্ডার জন্য আলাদা এলাকা নির্ধারণ করা রয়েছে। বিশাল সেই এলাকা। সেখানে পাণ্ডাকে রাখা হয়েছে তার নিজস্ব পরিবেশে। এমনকি যে আবহাওয়ায় পাণ্ডা সবচেয়ে ভালো থাকে সেরকম আবহাওয়া সৃষ্টি করা হয়েছে কৃত্রিমভাবে।

বিশাল বড় এলাকায় বাঁশ ঝাঁড় আর পাহাড়ি পথে চিড়িয়াখানায় পাণ্ডারা ঘুরে বেড়ায়। তাদের চেহারা ও স্বাস্থ্য দেখলেই বোঝা যায় চিড়িয়াখানায় রাজার হালে আছে তারা। আর আমাদের রয়েল বেঙ্গলকে আমরা রেখেছি ফকিরী স্টাইলে। খাঁচার সামনে গেলেই গন্ধে পেটের নাড়ি-ভূরি উল্টে আাসে। চিড়িখানার পুরানো আমলের খাঁচায় বন্দী বেচারা বাঘকে দেখলে মনে হয় সে যেন হত্যা মামলার আসামী। ঢাকা চিড়িয়াখানায় তো জায়গার অভাব নেই। জলা-জঙ্গলের মতো পরিবেশ কৃত্রিমভাবে তৈরি করে সেখানে বাঘকে রাখা যায় না? তাহলে তো তারা কিছুটা আরামে থাকতে পারে।  

দারিদ্র্য গুণনাশিনী। গরীবের ঘরে গুণী সন্তান জন্মালেও তার প্রতিভার বিকাশ হয় না আর তার কদরও থাকে না। গেঁয়ো যোগীর ভিখ না পাবার রীতি আমাদের দেশে বড্ড বেশি। আমরা জানি না কোনটা আমাদের সম্পদ এবং কিভাবে সে সম্পদ রক্ষা করতে হয়। আমাদের দক্ষিণ রায় অন্য উন্নত দেশে জন্মালে বিশ্বজয় করতে পারতো। কিন্তু আমরা উল্টো তার ঘর বসতি নষ্ট করার তাল করেছি। আর শুধু কি বাঘ? সুন্দরবন উজাড় হলে কত প্রজাতির পশুপাখি আর গাছপালা যে উজাড় হবে তার কি ইয়ত্তা আছে? ধ্বংস হবে বিশ্বের বিরল ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট।

সুন্দরবন বাংলাদেশের ফুসফুস। এমন কোন পাগল আছে যে গহনা কেনার জন্য নিজের ফুসফুস বিক্রি করে দেয়? একটা সুন্দরবন গড়ে তুলতে প্রকৃতির লাগে কয়েক হাজার বছর। আর এটি ধ্বংস করতে প্রয়োজন মানুষের একটি ভুল সিদ্ধান্ত। আশাকরি সকলের সম্মিলিত প্রতিবাদে সরকারের টনক নড়বে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র হোক কিন্তু সেটা কোনোভাবেই  সুন্দরবনে নয়। সুন্দরবন আমাদের অমূল্য সম্পদ, বাঘ আমাদের পরিচিতি। একে রক্ষা করতেই হবে, যে কোনো মূল্যে।

লেখক : কবি, সাংবাদিক

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।