নেপাল পারলে আমরা কেন পারছি না?
রাস্তাঘাটে চলার সময় প্রায়ই চিন্তা করি এমন একটা অ্যাপস খুব জরুরি। এই অ্যাপস ব্যবহার করতে হবে দেশব্যাপী। অ্যাপসটা কী সেটা আগে বলি। নারী পুরুষ নির্বিশেষে, কেউ যদি কারও গায়ে অশ্লীল উদ্দেশ্যে স্পর্শ করে তাহলে তার হাত তাৎক্ষণিকভাবে তীব্র ব্যথা হয়ে অবশ হয়ে যাবে। যদি অশ্লীলভাবে তাকায় বা ইঙ্গিত করে তাহলে চোখে কয়েক ঘন্টার জন্য কিছু দেখতে পাবে না। আর অশালীন মন্তব্য করলে কয়েক ঘন্টার জন্য জবান বন্ধ ও জিহ্বায় তীব্র ব্যথা।
আট দিনের জন্য কাঠমান্ডু গিয়েছিলাম নেটজ বাংলাদেশের আমন্ত্রণে একটা ওয়ার্কশপে অংশ নিতে। এর আগেও নেপাল গেছি কিন্তু এবারের মতো এইভাবে চিন্তার সুযোগ পাইনি। আমাদেরই পাশের দেশ। আমাদের চেয়ে দরিদ্র। অবকাঠামোগতভাবে আমাদের চেয়ে বেশ পিছিয়ে। কিন্তু নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে আমাদের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে। এই শহরে পর্যটকের অভাব নেই। যে এলাকার হোটেলে ছিলাম সেই থামেলে তো নেপালির চেয়ে বিদেশিই বেশি। পর্যটকদের মধ্যে তরুণী নারী, বৃদ্ধ নারী, সুন্দরী নারী, অসুন্দরী নারী, উন্নত বক্ষা নারী, অনুন্নত বক্ষা নারী-সব রকমই রয়েছে। পোশাকও তাদের বিচিত্র রকম। শর্টস, স্লিভলেসও যথেষ্ট পরিমাণে। কিন্তু বাচ্চা, কিশোর, তরুণ, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ কোনো বয়সের কোনো অবস্থানের নেপালি পুরুষই তাদের প্রতি কটাক্ষ, ইশারা, ইঙ্গিত, মন্তব্য, মুগ্ধতা কিছুই প্রকাশ করছে না। দেশি বিদেশি সব বয়সী সব রকম নারীই বেশ নিরাপদে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
থামেলে পায়ে পায়ে মদের দোকান, বার, ডান্সক্লাব ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বেশ রাতেও মদ খেয়ে রাস্তায় কেউ মাতলামি করছে বা ছিনতাই, হয়রানি করছে এমনটা তো চোখে পড়ে না। আমাদের দেশে রাস্তাঘাটে যেসব পুরুষরা মেয়েদের হয়রানি করে তারা প্রায়ই তোতাপাখির মতো একটা বুলি আওড়ায়। মেয়েদের পোশাক আশাক দেখেই নাকি তারা মাথা ঠিক রাখতে পারে না। আমাদের দেশে রাস্তাঘাটে মেয়েদের সাধারণ পোশাক হলো সালোয়ার কামিজ, ফতুয়া জিন্স আর নয়তো শাড়ি। আজকাল বোরখা হিজাবও প্রচুর দেখা যায়। সেই সব পোশাক দেখেই নাকি আমাদের পুরুষরা মাথা ঠিক রাখতে পারে না, জিভ, মুখ, চোখ, হাত কিছুই বশে থাকে না তাদের।
কাঠমান্ডু তো ইউরোপ আমেরিকায় না। ঢাকা থেকে তার দূরত্ব আকাশ পথে মাত্র দেড় ঘন্টা। তাহলে এই দেড় ঘন্টায় এমন কি হলো, যাতে সেখানকার পুরুষরা মেয়েদের পাশ্চাত্যের পোশাকে দেখেও নিজেদের সামলে রাখছেন। রাস্তাঘাটে ইভটিজিং তো দূরের কথা, মনে হলো কারও দিকে কারও তাকাবারও অবকাশ নেই। নেপালের পুরুষ কি তাহলে পুরুষ নয়? আমি বলবো এরাই পুরুষ। আর আমাদের দেশের বিকৃতমনা পুরুষগুলো হলো অমানুষ।
সমস্যাটা আসলে পোশাকের নয়। সমস্যাটা মানসিক গঠনের। নারীকে যৌনবস্তু হিসেবে না দেখে যদি সমান মর্যাদা সম্পন্ন মানুষ হিসেবে দেখতে পারে এদেশের পুরুষরা তাহলেই পথে ঘাটের হয়রানি থেকে নারীরা মুক্ত থাকতে পারে। এই সুস্থ মানসিকতায় পৌঁছাতে আমাদের আরও কত বছর লাগবে কে জানে।
ভূমিকম্পের পর এখন নতুন করে গড়ে উঠছে নেপাল। কাঠমান্ডুর দরবার স্কোয়ারে অনেক ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন ছড়িয়ে আছে। তারই মাঝখানে ভিড় প্রচুর। বিক্রি হচ্ছে হরেক রকম জিনিস। বিক্রেতার মধ্যে নারী পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান সমান। হোটেলে কাজ করছে, স্কুটি চালাচ্ছে, চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সব জায়গায় কাজ করছে নারীরা। সাবলীলভাবেই কাজ করছে তারা।
কাঠমুন্ডুর পাশে পাটনে বা ললিতপুরে নারী বিক্রেতার সংখ্যা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি। তারাও কাজ করছেন সাবলীলভাবে। সেখানে বেড়াতে আসা নারীও প্রচুর। পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু অত ভিড়ের মধ্যেও কোনো নারীকে কেউ হয়রানি করছে না। নারীদের চেহারা দেখেও মনে হয় না তাদের কোথাও কোনো আশংকা রয়েছে। কোনো পুরুষকে দেখলাম না সঙ্গী নারীকে আগলে রাখার জন্য ব্যতিব্যস্ত।
আমি শুধু ভাবছিলাম আমাদেরই মতো, আমাদেরই প্রতিবেশি, আমাদের চেয়েও দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষত-বিক্ষত একটি দেশ। অথচ সেই দেশের রাজধানীতে নারীরা কত স্বাধীন। ৪ সেপ্টেম্বর আমরা যখন দেশে ফেরার উদ্দেশ্যে ত্রিভুবন এয়ারপোর্টের দিকে যাত্রা করলাম তখন দেখি দলে দলে লাল রঙের পোশাক পরে মেয়েরা যাচ্ছে পথে। কি ঘটনা? আমাদের গাড়ির চালককে জিজ্ঞাসা করে বুঝলাম সেদিন একটি উৎসব রয়েছে, সেই উৎসব শুধুই মেয়েদের। কাঠমান্ডুর পথে পথে তাই লালপোশাকে মুক্ত, স্বাধীন হাস্যোজ্জ্বল নারীর বিচরণ। আহা ফিরে আসার পথেও মনটা জুড়িয়ে গেল আরেকবার। এমন মুক্ত আকাশ, স্বাধীন জীবন বাংলাদেশের মেয়েরা কবে পাবে!
লেখক : কবি, সাংবাদিক
এইচআর/আরআইপি