মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের অভিযাত্রায় বড় অগ্রগতি


প্রকাশিত: ০৬:০৩ এএম, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা ও একাত্তরের আলবদর কমান্ডার মীর কাসেম আলীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের অভিযাত্রায় এক বড়  ধরনের অগ্রগতি সাধিত হলো। গতকাল শনিবার রাতে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-২-এ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এর মধ্য দিয়ে কলঙ্কমোচনের পথে আরো একধাপ এগিয়ে গেল এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ। যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারায় শোষণ বঞ্চনাহীন, দুর্নীতিমুক্ত সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়াই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দেশমাতৃকার জন্য একাত্তরে যারা অকাতরে  জীবন বিলিয়ে দিয়েছে তাদের ঋণ শোধ করে দেশপ্রেমের জাগরণ ঘটাতে পারলে যুদ্ধাপরাধের বিচার আরো বেশি সফলতা নিয়ে আসবে এদেশের মানুষের জন্য।   

মীর কাসেম আলী একাত্তরে চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী বাহিনী আলবদর গঠনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মীর কাসেম আলী ছিলেন ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি এবং চট্টগ্রাম আলবদর বাহিনীর কমান্ডার। পরবর্তী সময়ে ছাত্রশিবিরেরও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এই যুদ্ধাপরাধী। তারই নেতৃত্বে ও রাজাকারদের সহযোগিতায় চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার পুরাতন টেলিগ্রাফ অফিস হিল রোডের মহামায়া ডালিম হোটেল, আছদগঞ্জে মোহাম্মদ পাঞ্জাবির ভবনের চামড়ার গুদাম, পাঁচলাইশ থানার সালমা মঞ্জিল প্রভৃতি জায়গায় নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে ওঠে। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও সে জড়িত। একাত্তরের গণহত্যায় মীর কাসেমের অপরাধের মাত্রা বুঝা যায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে ডালিম হোটেলকে ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’ হিসেবে উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে । এছাড়া নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার কারণে চট্টগ্রামবাসী মীর কাসেমের নাম দিয়েছিলেন ‘বাঙালি খান’। জামায়াতের শরীরে অর্থবিত্তের রক্ত প্রবাহের অন্যতম ভূমিকা পালন করে এই যুদ্ধাপরাধী। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সমাজে এরা পুনর্বাসিত হতে পেরেছিল। যার ফলে বিপুল অর্থবিত্তের মালিকও হয়েছিল মীর কাসেম। দিগন্ত মিডিয়াও তারই প্রতিষ্ঠান। অর্থ যে অপরাধ থেকে কাউকে বাঁচাতে পারে না মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করার  মধ্য দিয়ে তা আবারো প্রমাণিত হলো। কারণ জামায়াতের প্রধান অর্থ জোগানদাতা মীর কাসেম আলী এই বিচার ব্যাহত করার লক্ষ্যে দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঢালেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রভাবশালী লবিস্ট নিয়োগ করেছিলেন তিনি। কিন্তু ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।

যুদ্ধাপরাধের বিচারে একের পর এক চিহ্নিত ঘাতকদের সাজা হওয়া এবং তা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশ কলঙ্কমুক্ত হচ্ছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে সুষ্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল। এরপর সেই অঙ্গীকারের প্রতি জনরায় পেয়ে দলটি সরকার গঠন করে।  শুরু হয় যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া। দুটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভ করা হয়। ইতিমধ্যেই অনেকরই বিচার সম্পন্ন হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা, কামারুজ্জমান, সাকা চৌধুরী, আলী আহসান মুজাহিদ, মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির দণ্ডও কার্যকর করা হয়েছে। এখন বাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও যাতে শেষ করা যায় সেটিই প্রত্যাশা করছেন একাত্তরে স্বজন হারানো এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষজন।

যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিটি দীর্ঘদিনের। কিন্তু স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর  একাত্তরের ঘৃণ্য অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। সামরিক শাসক জিয়া ক্ষমতা দখল করে নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামীকে আবার রাজনীতি করার সুযোগ দেন। এ সময় কারাগারে বন্দি অনেক যুদ্ধাপরাধীকেও ছেড়ে দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে তারা আসন পাকাপোক্ত করে। খালেদা জিয়ার জোট সরকারে নিজামী-মুজাহিদ মন্ত্রীও হন। কিন্তু দেশের মানুষ সেটি মেনে নেয়নি। তারা সব সময়ই চেয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচার।

মীর কাসেমের ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধ বিচারের কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো। একাত্তরে স্বজন হারানোর বেদনা লাঘব করাই শুধু নয়, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যও যুদ্ধাপরাধের বিচার করা অত্যন্ত জরুরি। অপরাধ কখনো তামাদি হয় না, এবং অপরাধ করলে কেউ পার পায় না- এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে সমাজে নীতি নৈতিকতার উন্মেষ ঘটে। এ কারণে যুদ্ধাপরাধের বিচারের কোনো বিকল্প নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শোষণহীন, বঞ্চনাহীন, সমৃদ্ধ  অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠন করার প্রক্রিয়ায় এগুনোরও পথও পরিষ্কার হবে যদি স্বাধীনতা বিরোধী চক্রকে চিরতরে নির্মূল করা যায়।

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।