ঘুষ দিয়ে যায় চেনা


প্রকাশিত: ০৬:০৫ এএম, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের এক সময়ের ইউএনও এ এইচ এম আসিফ বিন ইকরাম এখন সুনামগঞ্জের শাল্লার ইউএনও বা উপজেলা নির্বাহী আফিসার। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি পত্রিকার খবর হয়েছেন। আর সেই খবর সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এক পাথর ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা নিয়েছেন, সেই টাকা স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে জমা করেছেন। তদন্তে সেটা প্রমাণিতও হয়েছে। কিন্তু তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন এই অর্থ গ্রহণের পেছনে কোনো ‘কু-উদ্দেশ্য’ খুঁজে পায়নি। আর মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব তাঁর সুপারিশে এটিকে ঘুষ হিসেবে বর্ণনা না করে ‘অসদাচরণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর ইউএনওর শাস্তি হিসেবে দুটি বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) বন্ধ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।

‘কু-উদ্দেশ্য’ খুঁজে পায়নি, তবে সু-উদ্দেশ্য পেয়েছে কিনা তাও পরিষ্কার করা হয়নি। আমলাতন্ত্র আমলাকে বাঁচাতে যা করার করছে। প্রমাণ হওয়ার পরও তাকে এমন ভালবাসাজাতীয় শাস্তি দিয়েছে। ঘুষ, দুর্নীতি আমাদের আমলাতন্ত্রে মজ্জাগত।

দুর্নীতি জিনিসটাই জটিল, বহুমাত্রিক। যত সহজে তা নিয়ে আমরা কথা বলি, মতামত জানাই, বিষয়টা ততখানি সহজ-সরল নয়। দুর্নীতি বলতে বুঝি ঘুষ নেয়া বা টাকা নয়ছয় করা। কিন্তু আমাদের সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীরাতো শুধু এটুকুই করেন না। সময়ের অপচয়ও একটা পরিমাপ। সরকারি কর্মীরা যদি গরহাজির থাকেন, যদি অকারণে কাউকে বহু দিন ঘোরান, তাওতো দুর্নীতি। যদি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করেন, সেটাও দুর্নীতি।

অনেকেই আশা করেছিলেন, বাংলাদেশে মুক্ত অর্থনীতি বা বাজার অথর্নীতি এলে ‘লাইসেন্স-পারমিট ব্যবসা’ শেষ হবে। সরকারি কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ কমবে, তাই দুর্নীতিও কমবে। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন উল্টোটাই ঘটেছে। বাজার খুলে যাওয়ার পর দুর্নীতি যেন বাজার পেয়েছে। একটা প্রত্যাশা ছিল সরকারি চাকুরেদের বেতন এমন একটা পর্যায়ে নিতে হবে যেন তারা ‘উপরি’ আয়ের কথা না  ভাবে, অর্থাৎ ঘুষ সংস্কৃতি থেকে সরে আসে। সরকার তা করেছে। এখন সরকারি কমকর্তা কর্মচারীদের বেতন আকাশ ছোঁয়া। কিন্তু তবুও তারা ঘুষ ছুঁতে দ্বিধা করে না।

অর্থনীতির বৃদ্ধি যত ঘটছে, ততই দাম বাড়ছে জমি, ফ্ল্যাট, স্মার্ট ফোনের। যারা এসবের লেনদেনে, আমদানীতে, বা পরিচালনায় সিদ্ধান্ত নেন, সেই নেতা-আমলাদের সামনে প্রলোভনও তাই আজ অনেক বেশি। সুযোগ বা নিজের পদ ব্যবহার করে আখের গুছিয়ে নেওয়া অনেকের কাছে খুব স্বাভাবিক কর্ম, দুর্নীতি নয়। দুর্নীতির ইন্ধন ও আয়তন, দুই-ই আজ বাংলাদেশে অনেক গুণ বেড়েছে।

রাজনৈতিক নির্বাচনের খরচ বহুগুণ বেড়ে যাওয়াও দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। নির্বাচন কমিশন খরচের একটা সীমা বেঁধে দেয় ঠিকই, কিন্তু কে তা মানে? আসলে রাজনীতিতে দুর্নীতি এড়ানো কঠিন হয়ে পড়ছে আর তার প্রভাব পড়ছে প্রশাসনে। বিচারব্যবস্থার দশাও তথৈবচ- মামলার পাহাড় জমে যাওয়ায় কোন কিছুর ফয়সালা সহজে হয় না। ফলে বিচার বিভাগেও দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়।
দুর্নীতির একটা বড় গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। একটা বড় অংশই আছে যারা মনে করছে, ‘সবাই ঘুষ খায়, তা হলে আমি খাব না কেন?’ সে ক্ষেত্রে ঘুষ খাওয়ার ঝুঁকিটা কম, লোকের কাছে নাম খারাপ হওয়ার ক্ষতিটাও কম। যারা মনে করেন, কড়া নজরদারি এবং কঠিন শাস্তি দেয়াই দুর্নীতিমুক্তির পথ, তারাও আসলে বিষয়টাকে অতি সরলীকৃত করে ফেলছেন। কেবল ঘুষখোরের শাস্তি বাড়ালে একটা আশঙ্কা যে ঘুষের অঙ্কটাই বেড়ে যেতে পারে, কেননা ঘুষখোরকে ঝুঁকি এখন বেশি নিতে হবে, তাই তার চাহিদাও বাড়বে।

শাস্তি দরকার, কিন্তু এ ছাড়াও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় এমন পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে ঘুষ খাওয়ার সুযোগ কমে যায়, এবং যাতে ঘুষ না- খাওয়াকেই ভাল বলে মনে হতে থাকে। কেবল নৈতিক বোধের কারণে নয়, নিজের স্বার্থরক্ষার বা সুবিধার জন্য। সিঙ্গাপুর ষাটের দশকে অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ছিল। সরকার কঠোর ছিল, শাস্তি ছিল। কিন্তু এর বাইরে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সংস্কার আনার ফলে সেটি এখন সবচেয়ে স্বচ্ছ দেশগুলির অন্যতম। কেমন ছিল সেই সংস্কার? সিঙ্গাপুরের শুল্ক বিভাগ খুব ঘুষখোর ছিল বলে কয়েক বছরের জন্য গোটা দফতরের কাজটাই ‘আউটসোর্স’ করে দেওয়া হয় সুইজারল্যান্ডের একটি সংস্থাকে। পরে যখন সেই দায়িত্ব আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয়, তখন নানা দফতরে শুল্কবিভাগের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও মাদক সমস্যা কমাতে নিউ ইয়র্ক শহরের পুলিশ বিভাগের একক ক্ষমতা রদ করা হয়, যোগ করা হয় কেন্দ্রীয় এফ বি আই ও প্রাদেশিক গোয়েন্দা নানা সংস্থাকে। বাংলাদেশেও যে কোনও সংস্থা বা কর্মকর্তাদের একক ডিস্ক্রিশনারী আধিপত্য বন্ধ করা দরকার, তাতে দুর্নীতির সুযোগ কমবে।

ঘুষখোর আর ঘুষদাতা দু’জনেই একটা ষড়যন্ত্রের অংশ হয়ে কাজটি করে। দু’পক্ষই চায়, কেউ যেন না জানে, বা কারও শাস্তি হয়। তাই শাস্তি ঘোষণার চেয়েও প্রশাসনিক নিয়মের পরিবর্তন বেশি প্রয়োজন। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোও দুর্নীতি কমানোর একটা উপায়। ই-টেন্ডারিং একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনলাইনে সেবা পাওয়ার বিষয়টি যত বাড়ানো হবে ঘুষের সুযোগ তত কমবে। জমির দলিল, পাসপোর্ট-এর মতো নানা নথি শুধু আনলাইন নির্ভর করা যায় কিনা সরকার ভাবতে পারে। কারণ কদিন আগেই জানা গেলো পাসপোর্ট-এর ভেরিফিকেশন করতে গিয়ে বিচারপতির স্ত্রীর কাছে টাকা চেয়ে বিপাকের পড়েছেন পুলিশের এক এসআই। বিচারপতির স্ত্রীর কাছে টাকা চাইতে পারলে সাধারণ মানুষকে কতটা হয়রানি করে এরা?  

বাংলাদেশে প্রশাসনের পদ্ধতি এমনই যে, বহু লোকের কোনও একটি কাজ আটকানোর ক্ষমতা রয়েছে। টাকা দিয়েও কাজ উদ্ধার হয় না, এমনই বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য আমাদের ব্যবস্থায়। ব্যবস্থার পরিবর্তন না এনে যদি কোমর বেঁধে ঘুষখোর খুঁজতে নামা হয়, তাতে লাভ খুব একটা হবে না।

Ishtiaque

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।