রিশা আফসানা তনুর মায়েদের আর কত কাঁদতে হবে?
আফসানা, তনু , সাবিরা, জনিয়া, শিশু সুমাইয়া জান্নাত, এর পর তালিকায় নতুন নাম যুক্ত হলো অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশা। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিলো কিশোরী মেয়েটি। গত ২৪ আগস্ট বুধবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে কাকরাইলের ফুটওভার ব্রিজে রিশাকে ছুরিকাঘাত করে একজন কাপড়ের দোকানের দর্জি। মেয়েটির পেটের বাঁ পাশে ও বাম হাতে ছুরিকাঘাত করা হয়েছিলো। চারদিন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে গত রোববার সকালে মারা যায় সে। কাপড় সেলাইয়ের উদ্দেশ্যে একটি ফোন নম্বর বিনিময়ের জন্যেই হয়তো ঝরে গেলো ফুলের মতো সুন্দর একটি কিশোরীর জীবন।
অন্যান্য বিষয়গুলো জানা না গেলেও বোঝা যাচ্ছে ছুরিকাঘাতের কারণ অতৃপ্ত কামনায় ব্যর্থতা। ভাবছি সিগ্মুন্ড ফ্রয়েডের সেই তত্ত্বটির কথা যেখানে ফ্রয়েড মনে করতেন মানুষ সহজাত হিংস্র প্রবৃত্তি নিয়েই জন্মায় এবং তা সভ্যতার চাপে অবদমিত থাকে। সময় সুযোগ মত মানুষ হিংসাশ্রয়ী, ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে। অবাক লাগছে কিভাবে সময় ও সুযোগ মতো একজন নিম্নশ্রেণির সেলাই শ্রমিক একজন স্কুলে পড়ুয়া ছাত্রীকে নির্ভয়ে প্রকাশ্যে দিবালোকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো! এটি মেনে নেয়া যায় না।
অতৃপ্ত কামনা, ধর্ষণের মধ্য দিয়ে হত্যা বা আত্মহত্যায় রুপ নিচ্ছে । কয়েক যুগ থেকে এই সময় পর্যন্ত হত্যা, ধর্ষণের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে এ বাংলাদেশ। এই সমাজে নারীর শরীরটি যেন পুরুষের ধর্ষণের জন্যে আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে। বেড়ে ওঠা উপযুক্ত শরীর নাগালে না পেলে ক্রোধে ক্ষতবিক্ষত করে, ছুরিকাঘাত করে, হত্যা করে পানিতে নিক্ষেপ করা যায়। এখানে ধর্ম বিবেককে বধ করতে পারেনা। এখানে মানবিকতা অন্যায়কে রুখতে পারেনা। এখানে নিজের কন্যাশিশুর অবয়ব ধর্ষককে প্রতিহত পরাস্ত করতে পারেনা। কখনো কখনো বালক শিশুর শরীরও বাদ যায় না এই অমানবিকতা থেকে।
অন্য কোনো প্রাণির ক্ষেত্রে নিজের শরীর একান্ত নিজের হলেও নারী ও শিশুদের শরীরটি যেনো কখনোই তাঁর নিজের হয়ে ওঠেনা। সেই শরীরটিকে পুরুষ কখনো ধর্ষণ করে, প্রচণ্ড ক্রোধে গুলি করে, গুলি করে তৃপ্তি না হলে কোপায়, এসিডে ঝলসে দেয়। চোখ উপড়ে ফেলে, ছোট কন্যাশিশুকে ধর্ষণ করতে না পেরে রাগে ক্ষোভে হত্যা করে পানিতে ভাসিয়ে দেয়। হত্যাকে আত্মহত্যায় পরিণত করার এবারের ধারাবাহিকতায় যোগ হয়েছে স্থাপত্যবিদ্যার শেষ বর্ষের ছাত্রী আফসানা ফেরদৌস। গত কিছুদিন আগে দুই যুবক অটোরিকশায় আফসানাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রেখে সিএনজি ভাড়া মেটানোর কথা বলে পালিয়ে যান। সেদিন রাতেই অপরিচিত মোবাইল ফোন থেকে আফসানার মাকে ফোন করে বিষয়টি জানানো হলে খবর পেয়ে তার মা ঠাকুরগাঁও থেকে আত্মীয়দের নিয়ে গভীর রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে গিয়ে তার লাশ শনাক্ত করেন। আফসানার কথিত আত্মহত্যাকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মেনে নিতে পারেনি তাদের পরিবার। কারণ তাদের দাবি, আফসানাকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁরা স্পষ্ট করে অভিযোগ করেন এক রাজনৈতিক নেতা ও তার সহযোগীদের। তারা হত্যার পর আমাদের সমাজের নতুন প্রবণতা হত্যাকে ‘আত্মহত্যার নাটক’ সাজিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছেন।
আফসানা হত্যাকে আবারো আত্মহত্যা বলে চালাতে চাইলো হন্তারক এবং তার সঙ্গি সাথীরা। অনেক প্রশ্নের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে একজন নারী নিজের বাসায় আত্মহত্যা না করে, অন্য বাসায় গিয়ে কেনো আত্মহত্যা করবেন? আফসানার কথিত স্বামী পলাতক কেনো? গত এক বছরে ধর্ষণ, ধর্ষণ জনিত কারণে হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার ঘটনা বেশ কয়েকটি ঘটেছে। বাংলাদেশের নারী ও শিশু হত্যা ধর্ষণের এই কথিত আত্মহত্যার ঘটনাগুলো এখন গ্রামের বাংলা সিনেমার কাহিনীর মতো। শুরুতেই বলে দেয়া যায় সমাপ্তি কি হবে। হত্যার ঘটনাগুলো প্রথমে আপোসের প্রস্তাব আসে,পরবর্তীতে ময়না তদন্ত রিপোর্টে তা আত্মহত্যায় রুপ নেয়। তাই এ নিয়ে মানুষের আর কোনো উত্তেজনা, আবেগ সহমর্মিতা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না।
হয়তো আগামীকাল আবারো কেউ ধর্ষিত হয়ে সিলিং ফ্যানে মাটিতে হাঁটু গেড়ে ঝুলবে, তখন অনেকেই হয়তো বলবে মেয়েটির আত্মহত্যার প্রবণতা ছিলো। এরপর সহপাঠীরা এক থেকে দেড় দিন ব্যানার নিয়ে বিচার চাইবে । দু`দিন পার হয়ে গেলে নতুন আরেকজন স্থলাভিষিক্ত হবেন। হত্যাকে আত্মহত্যা বানানোর এই প্রক্রিয়ায় এখন প্রয়োজন শুধু একটি ব্যানার যেখানে,বাঁচাও বাঁচাও শব্দ, শরীরে আচরের দাগ, আত্মহত্যা হয়েছে মাটিতে পা রেখে, ধর্ষিত নারীর পোশাক খারাপ ছিলো, এই সকল কমন শব্দগুলো থাকবে। শুধু নামের জায়গাটি শুন্য থাকবে যেন যে কোন নারী ধর্ষণ হলে বা ধর্ষণের শিকার হয়ে হত্যা হলে ঐ শূন্যস্থানে তাঁর নামটি সহজেই বসিয়ে দেয়া যায়। বিষয়টি কারো কারো কাছে বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে , কিন্তু বাস্তবতা আমাদের ক্রমাগত সেদিকেই নিয়ে যাচ্ছে । সেখানে কামদাপ্রসাদদের মতো ময়না তদন্তকারী ডাক্তারদেরও একটি তালিকা রাখলে মন্দ হয় না ।
এতো প্রতিবাদের পরেও তনু হত্যা রহস্য থমকে যাবে তা আমরা কখনো ভাবিনি। ভেবেছিলাম তনু সকল ধর্ষিত নারীদের প্রতিনিধি হয়ে ন্যায় বিচার পাবে। নারী ও শিশুর প্রতি এই সহিংসতার তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে ক্রমশই। জানি এ তালিকায় প্রতিনিয়তই স্থান পাবে রিশা, সুমাইয়া, তনুরা। ভাবতে অবাক লাগে একজন দর্জি, বাড়ির কাজের লোক যৌন কামনায় হত্যা করে ফেলে শাজনীন, রিশাদের মতো মেয়েদের। এইসকল নিম্ন ইতর শ্রেণির পশুরা সমাজ সংসার পাড়া মহল্লায় শুনে বড় হয় নারী পাপের বস্তু। তার সারা শরীর পাপের। সমাজ সংস্কৃতি প্রথা এভাবেই নারীকে হেয় করে আসছে যুগে যুগে। এর শেকড় উপড়ে ফেলা না হলে একটি দু`টি হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে আক্ষেপ করে কোন লাভ হবে না ।
প্রতিটি মানুষই স্বতন্ত্র মেধা মনন এবং সৃষ্টিতে, এই সচেতনতা এবং মর্যাদাবোধ গড়ে উঠতে হবে পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত। উন্নত-অনুন্নত অনেক দেশেই এখনো নারীর শরীরের অধিকার যেনো সে সমাজের প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস ও সংস্কৃতির দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। সমান যোগ্যতাসম্পন্ন এবং কখনো কখনো পুরুষের চেয়ে অধিক যোগ্যতা এবং মেধাবী হয়েও অধীনতাকেই ভালোবাসার আবরণে দেখার অনাকাঙ্ক্ষিত অদম্য আকর্ষণ নারীর। আকর্ষণ একজন পরিপূর্ণ যোগ্য নাগরিক এবং মানুষ হবার নয় নয়, একজন মমতাময়ী, আবেদনময়ী, কর্তব্য পরায়ণ পতিব্রতা নারী হয়ে ওঠার। আর নারীর এই কোমলতার একশোভাগ সুযোগ যুগে যুগে গ্রহণ করে আসছে পুরুষ। তাই নারী নিজের ক্ষমতায় নিজেও কখনো ক্ষমতাশীল হতে পারেনি। হতে পারে না নিজের যোগ্যতায় আস্থাশীল। কারণ ছোটবেলা থেকে নারীকে এখনো শেখানো হয় পরের ঘরে যেতে হবে। এ কথাটি না বলে এর পরিবর্তে যদি বলা হতো নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, তাহলে নারী নির্যাতনের এই ধারাবাহিক চিত্র হয়তো আস্তে আস্তে পাল্টাতে শুরু করবে। সেই দিনটি আর কতদূর?
লেখক : কলামনিস্ট
[email protected]
এইচআর/এমএস