সংকীর্ণতর হওয়ার আত্মঘাতী প্রচেষ্টা


প্রকাশিত: ০৫:৪১ এএম, ২৭ আগস্ট ২০১৬

দেশ মানে ধরাবাঁধা একটি ভূখণ্ডই শুধু? মনোভূমির খবর রাখে কে? প্রশ্নটি উঠছে ইদানীং সামাজিক মাধ্যমে। আর এর কারণ নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারী ক্লিনটনকে নাকি অর্থ দিয়েছেন তিনি।

হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তার সঙ্গে যারা ব্যক্তিগত কারণে দেখা করেছেন, তাদের অর্ধেক ব্যক্তি নিজে বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে অনুদান দিয়েছেন। এই তালিকায় রয়েছেন বাংলাদেশের নোবেল জয়ী মুহাম্মদ ইউনূসও। মার্কিন সংবাদ সংস্থা এপির তথ্য অনুযায়ী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা কালে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে তিনবার দেখা করেছেন বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস এবং টেলিফোনে কয়েকবার কথা বলেছেন। এপি বলছে, ওই সময় বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংকের দায়িত্ব থেকে মুহাম্মদ ইউনূসকে পদত্যাগে দেশটির সরকার চাপ দিচ্ছিল। সে কারণে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে দেখা করে সাহায্য চেয়েছিলেন মুহাম্মদ ইউনূস। তাকে সাহায্য করার কোনো পন্থা খুঁজে বের করতে সহকারীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন। এপি বলছে, এ সময় গ্রামীণ আমেরিকা, যে সংস্থাটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন মি. ইউনূস, ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে এক লাখ থেকে আড়াই লাখ ডলার অনুদান দিয়েছে। গ্রামীণ রিসার্চ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান, যেটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বেও রয়েছেন মি. ইউনূস, সেই প্রতিষ্ঠান থেকেও ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার ডলার অনুদান দেয়া হয়েছে।

বলতেই হবে যে, এটি একটি চমকপ্রদ খবর। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের একজন ব্যক্তি এমন ধনী দেশের একজন ধনী মানুষকে অর্থ দান করেন! এর আগে হিলারির সাথে ইউনূসের ইমেইল যোগাযোগের খবর জানাজানি হয়। ইউনূস শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হিলারির কাছে নালিশ জানিয়েছিলেন। তবে এবার জানা গেলো তিনি নালিশও করলেন, আবার অর্থও দিলেন।

ড. ইউনূসের নোবেল জয় বাংলাদেশের মানুষের জন্য যেমন গর্বের, তেমনি তাকে কেন্দ্র করে, বিশেষ করে গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যুতে, সরকারের ভূমিকা যেমন আলোচনায় এসেছে, তেমনি তার নিজের ভূমিকা নিয়ে নানা স্তরে প্রশ্নও উঠেছে। বিশেষ করে মার্কিন প্রশাসনের সাথে তার সম্পর্ক, নিজের স্বার্থ হাসিলে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও ব্যক্তিগতভাবে হিলারি ক্লিনটনকে দিয়ে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির যেসব কথা বাজারে প্রচলিত, সেগুলো কখনোই স্বস্তিদায়ক নয়।
নিয়ম ভেঙে, নিজেই নিজের তৈরি আইন ভেঙে ১০ বছর অতিরিক্ত সময় ধরে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে থাকা, ১/১১ এর সময় সেনাবাহিনী সমর্থিত সরকারকে দিয়ে দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে বিদায় করতে চেয়েছেন, এমন অভিযোগ আছে। গ্রামীণ ব্যাংকে থাকতে গিয়ে সুপ্রিমকোর্টের আপিলেও হেরেছেন, তবুও পদ ছাড়েননি। এসব ঘটনা তার সম্পর্কে কোন সুস্থ বার্তা দেয় না। এখন আবার এই অর্থ দানের খবর বিস্মিত করেছে দেশবাসীকে, যার কারণে নানা বিরূপ মন্তব্যও দেখা যাচ্ছে।

ফেসবুকে যেসব মন্তব্য আসছে তার মধ্যে একটি ছিল এমন- বিগত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। দেশের এই বন্যা কবলিতদের জন্য ড. ইউনূসের কোনো আর্থিক সাহায্যের খবর পাওয়া যায়নি। দেশের মানুষ না খেয়ে আছে, অথচ হিলারিকে খুশি করতে ২০ কোটি দিয়েছেন।

বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিষয়টি ফলাও করে প্রচার হওয়ার পর ক্লিনটন ফাউন্ডেশন নিয়ে মানুষের কৌতূহল জেগেছে। ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ হচ্ছে এটি একটি স্ব-বিরোধী সংগঠন। ডেইলি ওয়্যারের এক প্রতিবেদনে বলা হয় হিলারি তার ক্যাম্পেইনে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বললেও এমন দেশ থেকে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের অনুদান আসে যাদের যেখানে নারীর ক্ষমতায়নের কোনো বালাই নেই। প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে সবচেয়ে বড় অনুদান আসে সৌদি আরব থেকে এক কোটি থেকে আড়াই কোটি টাকা অনুদান দেয় তারা। প্রায় এক কোটি ডলার আসে কুয়েত থেকে আর ৫০ লাখ ডলার দেয় কাতার। শান্তিতে নোবেল জয়ী একজন এমন ফাউন্ডেশনের সাথে শুধু সম্পর্কই রাখেন না, অর্থও দেন, এটি বিস্ময়কর ঠেকে।

বেশ অনেকদিন ধরে প্রফেসর ড. ইউনূসকে নিয়ে বিতর্ক চলছে। এই বিতর্ককে অনেকে সমালোচনা করলেও একটা ইতিবাচক দিকও পাওয়া যায়। যিনিই হোন না কেন, তিনি যে সমালোচনার উর্ধ্বে নন, সেটা মানুষের সামনে উঠে এসেছে। ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম দারিদ্র বিমোচনে সহায়ক বলে বিশ্বের বহু দেশে স্বীকৃত হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা দারিদ্র বিমোচনের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় প্রফেসর ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি বাংলাদেশকে সারা বিশ্বে পরিচিত করেছেন। কিন্তু এ প্রশ্নও অনেকে রাখছেন দেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছেন এ কারণে বাংলাদেশ নামক রাষ্টের চেয়ে কি ব্যক্তি ইউনূস বড়? ক্ষুদ্র ঋণের ভাল মন্দ দিক নিয়েও আলোচনা হচ্ছে যা এক সময় একেবারেই হচ্ছিল না।
 
ড. ইউনূস চাইলেই গ্রামীণ ব্যাংকের পদমর্যাদা ছেড়ে দিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত দেখাতে পারতেন যা তার কাছে প্রত্যাশিত ছিল। নির্দিষ্ট বয়সসীমা পার হয়ে যাওয়ার পরও পদমর্যাদা বহাল রাখার গ্রহণযোগ্যতা-অগ্রহণযোগ্যতার সাথে নোবেল প্রাপ্তিকে গুলিয়ে ফেলেছেন অনেকে। সেটা কি কিছুটা দূর হবে হিলারিকে অর্থ দানের খবরে?

পদমর্যাদা ফিরে পেতে আন্তর্জাতিক লবিং করে ড. ইউনূস বারবার এই প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন তিনি যোগ্য নেতৃত্ব প্রদানকারী নন, কারণ তার কোন উত্তরসূরি তিনি তৈরি করতে পারেননি, যাকে অবলীলায় দায়িত্বভার অর্পণ করা যায়। ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংককে গরিবের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলেছেন বারবার। গ্রামীণ ব্যাংক কতটা গরিবের ছিল বা আছে?

মনুষ্যকূলে বুদ্ধিজীবী শ্রেষ্ঠ। কেননা, তাঁরা সকলেই বৃহদর্থে সমাজের নিচের ধাপের, ক্ষমতাহীন সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রেণিগুলোর পক্ষে সংগ্রামের ভিন্ন ভিন্ন পথ নিয়ে থাকেন। তাঁরাই মানুষের কাছে থাকেন সুখে, দুঃখে। দেশ যখন জঙ্গি আর সন্ত্রাসী আক্রান্ত কোথাও কি পাওয়া গেলো তাঁকে? যায়নি, কারণ তিনি শুধুই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। এতো এতো লেখক, ব্লগার, পুরোহিত, সংখ্যালঘু হত্যা হলো, আওয়াজ নেই্ কিন্তু আওয়াজ তার পাওয়া গেলো হলি আর্টিজান ঘটনায়। কারণ এখানে বিদেশিরা আক্রান্ত হয়েছে।

দরিদ্র, অবদমিত, ক্ষমতাবৃত্তের বহু দূরে থাকা নিষ্পেষিত জনতার পক্ষে যে সব কণ্ঠস্বর সবচেয়ে জোরালো, তাদের মধ্যে তাঁকে খুজে পাওয়া যায় না। অথচ ভারতে এ ক্ষেত্র অগ্রগণ্য মানুষ অমর্ত্য সেন। আসলে ড. ইউনূস এক মনে নিজেকে সংকীর্ণতর করার আত্মঘাতী প্রচেষ্টায় ব্যস্ত।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।