ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির প্রভাব কেন কমছে?


প্রকাশিত: ০৫:৩৯ এএম, ২০ আগস্ট ২০১৬

যে মেয়েটি স্কুল, কলেজের সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যমনি হিসেবে সক্রিয় ছিল, গান গাইতো, নৃত্য করতো, সে আজ পুরোপুরি অন্য মানুষ। এখন সে ছক কাটে কখন শিল্পী, সংস্কৃতি কর্মী, উদার ও অসাম্প্রদায়িক, কিংবা অন্য ধর্মের মানুষকে খুন করা যায়। বলা হচ্ছে চিকিৎসক ঐশীর কথা যে সম্প্রতি আরো তিন নারী জঙ্গিসহ আটক হয়েছে। তার পরিবার বলছে ইন্টারনেটে প্রবাসী কোন একজনের মাধ্যমে মগজ ধোলাই হয়েছে তার।

গুলশান ট্র্যাজেডির পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সাঁড়াশি অভিযানের ফলে বিভিন্ন নামে তৎপর থাকা জঙ্গিরা ধরা পড়তে থাকে। নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবির চার নারী সদস্য গ্রেফতার হয়েছে সম্প্রতি। গ্রেফতারকৃত একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক, বাকি তিনজন বেসরকারি মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের  শিক্ষার্থী।  বলা দরকার এই বিশ্ববিদালয়টি জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং এর অন্যতম পরিচালক এক সময় ছিলেন জামায়াতের সাবেক আমীর মতিউর রহমান নিজামীর স্ত্রী।

ইন্টার্নি শেষ করার পর একজন চিকিৎসকের যেখানে মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করার কথা, সেখানে কেন একজন মেধাবী চিকিৎসক ভুলপথে পা বাড়াল তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। যাদের প্ররোচনায় মেধাবী তরুণ-তরুণীরা বিভ্রান্ত হচ্ছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি। জঙ্গি কার্যক্রমের প্রসারে অর্থদাতাদেরও চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।  জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত এক নারী জঙ্গি জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে সে জিহাদি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। তার মতো আরও কত নারী জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত, তা অনুসন্ধানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।

কিন্তু সমস্যার সমাধান শুধু যে, পুলিশী বা প্রশাসনিক পদক্ষেপে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবেনা সেটা সবাই বুঝতে পারছেন। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির প্রভাব কমেছে কেন সেই বিশ্লেষণও প্রয়োজন। এখন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি যেন বলার জন্য বলা, কেমন কণ্ঠহীনতা। সে এখন রাজনীতির এজেন্ডা স্থির করে না, কেবল জবাব দেয়, প্রতিরোধ করে, কৈফিয়ত খোঁজে। সে দুর্বল, কেমন যেন আত্মপ্রত্যয়হীন। এই দুর্বল, প্রতিক্রিয়াজীবী ধর্মনিরপেক্ষতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই সবাইকে মোহগ্রস্ত করছে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর উল্টোপথে চলেছে বাংলাদেশ। ধর্মীয় উগ্রবাদ আর সাম্প্রদায়িকতাকেই মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে সচেতনভাবে। তারই সম্প্রসারিত রূপ আজকের জঙ্গিবাদ।

কিন্তু যারা প্রগতিশীলতার কথা বলে, বা যে দল উদারনৈতিক অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে বলে জনগণকে জানায়, তারাও প্রতি পদ পদে এই সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে আপোস করেছে, যোগসাজস করে ক্ষমতালিপ্সু থেকেছে।

সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জনযুদ্ধ করে জেতা বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুঁজি করে এগুবে এটা ছিল প্রতিজ্ঞা। তাই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল এই দেশে। কিন্তু কারা এসে সব পুরোপুরি উল্টে দিল সেটা আরেক ইতিহাস। জাতীয়তাবাদের নামে নতুন এক রাজনীতি ঘটা করে সামনে নিয়ে এলো সাম্প্রদায়িক বিষ। আসলে যা কিছু প্রতিক্রিয়াশীল তাই জাতীয়তাবাদকে আশ্রয় করে এলো। আধিপত্যকামী জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশে সহজেই সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতাকে আশ্রয় করে তৈরি হলো এক জঙ্গি রাজনীতি, যারা রগ কাটে, মন্দির ভাঙ্গে, মুখে ধর্মের নাম জপে জপে সব অধর্ম করে। বঙ্গবন্ধু যে উন্নয়নের কথা ভাবতেন, উদার ধর্মনিরপেক্ষ শাসনতন্ত্র তার পক্ষে জরুরি ছিল। এই কারণেই রাষ্ট্রের অধিনায়কত্বে বিকাশ বা উন্নয়নের ভাবনাকে তিনি সে দিন সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের থেকে বেশি জরুরি বলে মনে করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে সাঙ্গ হয় উদারতার প্রচেষ্টা। তবে প্রশ্ন জাগে যে, আওয়ামী লীগ পরিবর্তিত পরিস্থিতে হারিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কি ভূমিকা ছিল বামপন্থীদের? তারা আসলে ঠিকই করতে পারেননি তাদের ভূমিকাটা কি হবে। চীন আর রুশ লাইনে বিভক্ত হয়ে কেউ হয়েছেন ইসলাম পন্থী (চিন পন্থীই বেশি এই লাইনে) আর কেউ হয়েছেন পথ হারা।

আমাদের ধর্ম-সম্পৃক্ত সমাজের ইতিবাচক আদর্শ ও আচরণবিধিকে সঙ্গে নিয়ে যে ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো যায়, ধর্ম নিরপেক্ষতার রাজনীতি আমরা যারা করেছি তারা সেই সত্য সঙ্গে করে নিয়ে চলিনি সবসময়। আর এই ব্যর্থতার কারণেই ধর্মীয় রাজনীতি এতটা প্রতিপত্তি তৈরি করতে পেরেছে। স্বাধীনতার বিরোধিতা করেও সেই রাজনীতির অনুশীলনকারীদের মুখেই আবার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের কথা বেশি উচ্চারিত হয়েছে।

এই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ভিত্তি পেয়েছে সামরিক শাসকদের মাধ্যমে। তাদের বিরুদ্ধে লড়াই হয়েছে, লড়াইয়ে তারা পিছু হটেছে, কিন্তু হারেনি। তাই এখন ক্ষমতার বলয়ের বাইরে থেকেও তারাই তারুণ্যকে এমনভাবে প্রভাবিত করছে, করতে পারছে। একটা প্রকৃত উদার, সর্বজনীন সামাজিক-অর্থনৈতিক জাতীয়তার বলিষ্ঠ মূর্তি সরবরাহ করতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা পারেনি বলেই উদারতার পথ থেকে সরে যাচ্ছে তরুণ-তরুণীরা।

আরেকটি বড় কারণ হয়তোবা ছিল যে, বৃহত্তর সমাজ থেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকদের বিচ্ছিন্নতা। আমরা পুঁজিবাদী বিকাশের দিকে এগিয়েছি, অসাম্য ক্রমশ বেড়েছে, বাড়ছে। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দেবে, এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে? প্রতিটি রাজনৈতিক দল ভোটব্যাংকের রাজনীতির তাগিদে এই মেরুকরণকেই কাছে টেনেছে, হাওয়া দিয়েছে। তাই প্রতিক্রিয়াশীল বিএনপি ও জামায়াতকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে পারলেই দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে সেটা খুব কার্যকরী ভাবনা বলে মনে হচ্ছে না।

বৈষম্য হটিয়ে গোটা দেশের মানুষের সামগ্রিক উন্নয়ন, শ্রেণি সংঘাত ঘোচানোটাই বরং হ্যাঁ-সূচক ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিষ্ঠিত করবে অনেক বেশি। শুধু মুখে নয়, বাস্তবের জমিতে দাঁড়িয়ে গোটা দেশের সামগ্রিক আর্থিক বিকাশের প্রশ্নে আরও সৎ থেকে এগুতে হবে। বঙ্গবন্ধুর যে উদার বহুত্বধর্মী উন্নয়নবাদকে বাস্তবায়িত করা আজও সম্ভব হয়নি, দৃঢ়ভাবে সে পথে এগোলেই পাওয়া যাবে সেই কাঙ্খিত ধর্মনিরপেক্ষতা।

syed

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।