অর্গাজমেও নারীর আত্মত্যাগ!

ইশরাত জাহান ঊর্মি
ইশরাত জাহান ঊর্মি ইশরাত জাহান ঊর্মি
প্রকাশিত: ১০:৩০ এএম, ১৭ আগস্ট ২০১৬

ঘটনাটা তনু হত্যাকাণ্ডের সময়ের। ডা. কামদাপ্রসাদ সাহা ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দিলেন যে, তনুর ধর্ষণ হয় নাই, ইন্টারকোর্স হয়েছিল। ক্ষুব্ধ হয়ে লিখেছিলাম ফেসবুকে, ‘কারে ধর্ষণ বলে আর কারে ইন্টারকোর্স, জাতিরে এখন নতুন করে তা শিখতে হবে কামদাপ্রসাদের কাছে।’ নিচে একজন কমেন্ট করলেন, : হাহাহা, তো এই বিষয় কি তুই শিখাবি না কি? আসবো?

ভদ্রলোক আমার পরিচিত। ফ্রেন্ডলিস্টে তো আছেনই। এমনিতেও পরিচিত। সমাজে পরিচিতর খোলসে অনেক অপরিচিত নিয়ে আমাদের বাস করতে হয়। আজ ফিমেল অর্গাজম ডে নিয়ে উইম্যান চ্যাপ্টারে খুবই সুলিখিত আর তথ্যবহুল একটা লেখা পড়ে এই ঘটনাটা মনে পড়ল। যে সমাজে এখনও নারী-পুরুষের স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক নিয়ে মন খুলে কথা বলারই কোন পরিবেশ নেই সেখানে নারীর অর্গাজম তো একটা খুবই বাহুল্য বিষয়। আপামর পুরুষরা একে অশ্নীলও বলতে সময় নেবেন না। কিন্তু বিষয়টা আগে বুঝি। গুগল করে যেটুকু বুঝলাম তা হলো ৮ আগস্টকে ফিমেল অর্গাজম ডে হিসেবে পালন করা হয়। ব্রাজিলের উত্তর-পূর্ব অংশে ছোট একটি শহর এসপারনন্টিনা। এই শহরের একজন কাউন্সিলর হোসে আরমেতিয়া দান্তেস লাসের্দা। তিনিই প্রথম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রীর প্রতি কিছু যৌন ঋণ শোধ করবেন বা যৌন ক্ষতিপূরণ দিবেন। প্রস্তাব রাখলেন একটি উৎসর্গ করা হোক নারীর জন্য "সবচেয়ে বেশি উত্তেজনাকর আর অভিব্যক্তির সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ" এ।

ব্রাজিলে দিনটা ছুটির দিন। এরপর ২০০৭ সাল থেকে প্রতি বছর ৮ আগস্ট এই দিবস পালিত হয়ে আসছে। এখন ব্রাজিল ছাড়াও স্পেন, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, পেরু এবং নরওয়ে এসব দেশে নারীর আনন্দের জন্য এই দিনটিকে উৎসর্গ করা হয়েছে। বলা হয়েছে নারীর অর্গাজম হলো সেক্সের সবচেয়ে রহস্যময় অংশ। বিশ্বের অনেক নারীই সেক্স করার সময় জীবনে অর্গাজমের স্বাদ পাননা।  যৌনতার চরম পুলকে পৌঁছান অতি অল্প নারী।

ভাবুন তো আমাদের অজ পাড়াগাঁ এর কতশত নারীর মুখ। যারা শুধুই স্বামীর সংসার করে, স্বামীর নিচে পিষ্ট হয় বছরের পর বছর। কতশত জোকস তৈরি হয়েছে, নারীর অসম্পূর্ণ সেক্স নিয়ে। অকালবিধবা নারীর যৌনযাতনা নিয়ে উত্তেজক সব জোকস। আমাদের সমাজ নারীকে নিয়ে ইয়ার্কি করতে পছন্দ করে, তার বেদনা দেখতে পছন্দ করে না। নারীর অর্গাজম হতেই হবে কেন? তার সঙ্গে তো সন্তান উৎপাদনের কোন সম্পর্ক নেই। পুরুষের পুলক তথা অর্গাজমের সঙ্গে যেমন নারীর গর্ভধারণের সম্পর্ক রয়েছে তেমন নারীর অর্গাজমের তো কোন সম্পর্ক নাই। তাহলে কি নারী আধামানব? শারীরিক সুখের ক্ষেত্রেও কি প্রকৃতি তাকে কিছুটা ব্যাকফুটে রাখলো? না কিন্তু।

একজন মানুষ হিসেবে সেক্সের সময় চরম পুলক পাওয়াটা নারীর অধিকারও বটে। কিন্তু আমাদের মতো দেশে নারীর স্বাভাবিক প্রেম ভালোবাসাই যেখানে প্রকাশিত করার সুযোগ নেই, সেখানে অর্গাজম নিয়ে অধিকারের লড়াই? যেখানে যেকোন সম্পর্ককে "বৈধ-অবৈধ"র তিলক লাগিয়ে ঘুরতে হয় সেখানে এই লড়াই? নিজেরই ভাবতে বিসদৃশ লাগছে। এটা খানিকটা সামাজিক ব্যবস্থাপনার সাথেও জড়িত। গ্রামের নারীদের কথা বললাম, শহরের মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত নারীদের কথাও যদি বলি, খুব কিন্তু আলাদা নয় চিত্রটা। অনেক নারীই এমনকি স্বামী বা প্রেমিকের পুলকের জন্য অর্গাজমের ভানও করেন। সংসার টিকিয়ে রাখতে হবে তাই এই ভান।

মা হয়েছেন, বাচ্চা ঘুমাচ্ছে, একজন নারী স্বামীর সাথে মিলিত হওয়ার সময় মাথায় রাখেন, বাচ্চার ঘুম ভাঙলো কি না। যদি মাথায় না রাখেন, তাহলে নিজের কাছেই ছোট হয়ে থাকেন। এ্যাজ ইফ বাচ্চার দেখভাল করা শুধুই নারীর একার বিষয়। এবং এই সময়ে সেক্স করাটাও অনেকসময় অপরাধবোধের জন্ম দ্যায়। এটাও কিন্তু সামাজিক বিষয়ই। নারীকে বাচ্চা এবং স্বামী দুইদিক এইসময় যতটা খেয়াল রাখতে হয়, একজন পুরুষকে কিন্তু ততটা নয়। অর্থাৎ যৌন পুলকের ক্ষেত্রেও দিনের পর দিন স্যাক্রিফাইস মুডে থাকতে হয় নারীকে। আবার যৌনক্রিয়াটা খাওয়া-ঘুম-গোসলের মতো অতি নিত্য সাংসারিক বিষয়ও বানিয়ে ফেলেন নারী এবং পুরুষ উভয়ই। এটা অবশ্যই নিত্য প্রয়োজনীয় একটা বিষয় কিন্তু সেজন্য আলাদা কিছু প্রস্তুতির বিষয় থাকে। যে প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষকে যেতে দেয় না সামাজিক ব্যবস্থা। সামাজিক বিষয় এইজন্য বললাম যে, এসব থেকে এই রিজিয়নের অসংখ্য নারী বের হয়ে আসছে।

ভারতের টেলিগ্রাফের এক সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে, এখন সেখানকার ৪৫ ভাগ নারী যৌন ক্রিয়ায় "প্যাসিভ রোল" নয় "অ্যাকটিভ রোল" প্লে করে। এবং ৫৩ শতাংশ নারী বিয়ের আগেই যৌন সম্পর্কে জড়ায়। জড়ায় কারণ তারা জড়ানোর মতো অর্থনৈতিক এবং সামাজিক হিম্মত রাখেন। আর এটাই জরুরি। আর এখন স্বামীরাও বুঝেছেন যে এটা পুরুষের একার প্লেজার এর বিষয় নয়। নারী বা পুরুষ সেক্সে কি রোল প্লে করবেন তা একান্তই তাদের ব্যক্তিগত রুচি বা পছন্দের বিষয়। কিন্তু সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে নারীর অর্গাজম না ঘটানোর ফলে অনেক নারী এখন পুরুষের সাথে সঙ্গম ছাড়াই অর্গাজমের দিকে ঝুঁকছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কিনসি ইন্সটিউটের রিসার্চ। এটা সুস্থতা না অসুস্থতা তা পরের বিষয়।
কিন্তু সকলরকম আত্মত্যাগ এমনকি সেক্সের সময় অর্গাজমের আত্মত্যাগও নারীকেই কেন করতে হবে- সেসব নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। মহামান্য সমাজ-আপনি নারীদের নিয়ে ভাবুন। ভাবাটা এ্যাটলিস্ট চর্চা করুন। সমাধান আসবেই।

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার , ডিবিসি নিউজ

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।