রবীন্দ্রনাথ ও কৃষি


প্রকাশিত: ০৪:১৪ এএম, ১৬ আগস্ট ২০১৬

বর্ষার ২২ শ্রাবণ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাপ্রয়াণ দিবস। আমাদের রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি ছিলেন। কবিতা আর কাব্যগ্রন্থ্যের উৎকৃষ্টতায় তিনি বিশ্বের সেরা লেখক হিসেবে সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল বিজয়ী হয়েছেন। বাংলা ভাষাভাষি হিসেবে এটি আমাদের জন্য পরম গর্বের বিষয়। তিনি শুধু কবি ছিলেন না। একাধারে গল্পকার, প্রবন্ধকার, ছড়াকার, নাট্যকার, গীতিকবিÑ কিনা ছিলেন। অর্থাৎ সাহিত্যের এমন কোনো দিক নেই যেখানে তার আয়েশি বিচরণ ছিল না। সেজন্য আমাদের রবীন্দ্রনাথ বিশ্বজয় করেছেন তার যোগ্যতা আর মেধা মনন বিনিয়োগে। কিন্তু আমরা অনেকে হয়তো জানি না কবিগুরু কৃষির জন্য কী অসামান্য অবদানই না রেখে গেছেন। সারা জীবন কবিতা-সাহিত্য রচনা করেছেন গ্রামের মানুষ আর গ্রামীণ পরিবেশে। মাটির সোঁদা গন্ধের আবাহনে বোধকরি কবিকে মাতোয়ারা করত অহরহ। মাটির টানে কৃষির টানে তিনি অনেক অসামান্য অবদান রেখে গেছেন।

বাংলাদেশে ঠাকুর পরিবারের তিনটি জমিদারি পরগনা বা এস্টেট ছিল। এগুলো হলো বিরামপুর, শাহজাদপুর এবং কালীগ্রাম। বিরামপুরের সদর দফতর ছিল কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহ। শাহজাদপুরের সদর দফতর সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর এবং কালীগ্রামের সদর দফতর ছিল বর্তমান নওগাঁ জেলার পতিসর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর পারিবারিকভাবে দায়িত্ব পড়ে ছিল এসব পরগনার জমিদারি দেখাশোনা করা এবং খাজনা আদায় করা। সে সূত্রে তিনি কলকাতা থেকে বাংলাদেশে প্রথম আসেন ১৮৯০ সালে। বিরামপুর, শাহজাদপুর এবং কালীগ্রামÑ এসব এলাকা ঘুরে তিনি দেখেছেন কৃষকের দৈনন্দিন অবস্থা। তিনি লক্ষ্য করেছেন কীভাবে গ্রামের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক স্থানীয় মহাজনদের ঋণের শিকলে বাঁধা পড়ে জিম্মি হয়ে আছেন। তিনি দেখেছেন সেখানকার পতিত জমি, একফসলি জমি, অনুর্বর জমি। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ছোঁয়া নেই কোথাও। সবই চলছে গতানুগতিকভাবে। তাই গরিব প্রজাদের কথা ভেবে তিনি নজর দিয়েছিলেন গ্রাম বাংলার কৃষি উন্নয়নে। এর ফলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সামাজিক জীবনে কেবল একজন প্রজাবান্ধব জমিদার ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে যে সুপরিচিত ছিলেন তা কিন্তু নয় বরং আধুনিক কৃষির একজন রূপকার হিসেবেও তিনি ছিলেন জনপ্রিয়।


গ্রাম বাংলার দরিদ্র ও দুস্থ কৃষকের মাঝ থেকে কবি গুরু খুঁজে পেয়েছিলেন উপেনের চরিত্র, লিখেছিলেন কালজয়ী কবিতা ২ বিঘা জমি। মহাজন, জমিদারদের কবল থেকে এসব উপেনদের বাঁচাতে স্বল্প সুদে ক্ষুদ্রঋণের কথা ভেবেছিলেন তিনি। এ ভাবনা থেকেই স্বল্প সুদে গরিব কৃষকের মধ্যে ঋণ বিতরণের জন্য ১৮৯৪ সালে শিলাইদহে এবং ১৯০৫ সালে পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। এ ধরনের ব্যাংক গড়তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাথমিক পুঁজি সংগ্রহ করেছিলেন বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে। পরে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর নোবেল প্রাইজের টাকা থেকে ১ লাখ ১৮ হাজার টাকা দান করেছিলেন পতিসর কৃষি ব্যাংকের তহবিলে। সে সময় পতিসর কৃষি ব্যাংক থেকে শতকরা ১২ টাকা সরল সুদে কৃষি ঋণ দেয়া হতো। কৃষি ব্যাংককে কেন্দ্র করে শিলাইদহ ও পতিসরে তিনি গড়ে তুলেন পল্লী সমাজ সংগঠন এবং প্রচলন করেন সমবায়ভিত্তিক যৌথ কৃষি খামার।

 তবে আধুনিক কৃষির রূপকার হিসেবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে সময় কৃষকের দোরগোড়ায় আধুনিক ও লাগসই কৃষি প্রযুক্তি পৌঁছে দেয়ার বিষয়টি ভেবেছিলেন গভীরভাবে। তাইতো তিনি যুবক কৃষকের জন্য ফসল ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন শিলাইদহ এবং পতিসরে। কৃষককে সংগঠিত করে গড়ে তুলেছিলেন শস্য বা বীজ ব্যাংক। পতিসরে প্রচলন করেছিলেন শস্যপর্যায় অর্থাৎ ক্রপ রোটেশন এবং শস্য বহুমুখীকরণ কার্যক্রম অর্থাৎ ক্রপ ডাইভারসিফিকেশ প্রোগ্রাম। এছাড়া পতিসরে যান্ত্রিক চাষাবাদ প্রচলনের জন্য তিনি কলকাতা থেকে নিয়ে আসেন ৭টি ট্রাক্টর। তিনি এখানেই থেমে থাকেননি, পতিসরের কৃষকের জন্য আমেরিকা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন আধুনিক জাতের ভুট্টার বীজ, মাদ্রাজ থেকে নিয়ে এসেছিলেন উচ্চফলনশীল জাতের ধানের বীজসহ অন্যান্য বীজ।

কৃষকের মাঝে আধুনিক বা উচ্চতর কৃষি প্রযুক্তি হস্তান্তরে দরকার হয় কৃষি বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষিত জনশক্তি বা মানবসম্পদ। এক্ষেত্রেও তিনি থেমে থাকেননি। তার নিজের ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মেয়ের জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপধ্যায় এবং বন্ধুর ছেলে সন্তোষ মজুমদারকে আমেরিকার ইলিয়নস বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন কৃষিতে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। যাতে তারা কৃষি বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষিত হয়ে পতিসরে এসে ফসল ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ে কৃষককে সহায়তা করতে পারেন এবং তারা যথারীতি কৃষি বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষিত হয়ে কৃষকের সম্প্রসারণ সেবা দিয়েছিলেন।

বিশ্বকবি তার নোবেল পুরস্কারের যে অর্থ পেয়েছেন তার সিংহভাগ ব্যয় করেছেন কৃষির জন্য। তিনিই কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন গরিব কৃষকের কৃষি উন্নয়ন এবং কৃষক সহজ সরল শর্তে কৃষিঋণ পেয়ে তারা কৃষি কাজ ভালোভাবে করতে পারবে। যার ফলে কৃষি  তথা ফসলের ফলন অনেক বেড়ে যাবে। তখন দেশ জাতিতে কৃষিতে সমৃদ্ধ হবে। অনেক সময় কৃষক যখন ঋণ পরিশোধ করতে পারতেন না তখন বিনয়ের সাথে কবিগুরুকে মিনতি করে বললে সব মাপ করে দিতেন। রবীন্দ্রনাথই প্রথম যিনি নোবেল বিজয়ের টাকা দিয়ে কৃষকের কল্যাণে এবং কৃষির আধুনিকায়নে কলের লাঙল তথা ট্রাক্টর কিনে দিয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল কৃষক অনেক কষ্ট করে গরু দিয়ে দিনের পর দিন মাথার ঘাম ফেলে শ্রম বিনিয়োগে সামান্য পরিমাণ জমি চাষ করতে পারে। আর ট্রাক্টরের মাধ্যমে অতি অল্প সময়ে অনেক জমি চাষ করা যায়।  কৃষকের কষ্ট কমে যায়। সবচেয়ে বড় কথা লাভ বেশি হয়, ফলন বেশি হয়।

কবিগুরু নওগাঁর পতিসরে কৃষকের জন্য কৃষিঋণের ব্যবস্থা করেছিলেন। যার ফলে সেখানে পুঁজির অভাবে যে কৃষিক্ষেত্রে সমস্যা হতো তা দূর হয়ে কৃষির অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছিল। ভারতের শান্তি নিকেতন এবং বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জের শাহবাজপুর, কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহে তিনি বনবীথি, ছায়াবীথি, ফলবীথি গড়ে তুলেছিলেন সেটি ছিল অভাবনীয়। বিশেষ করে বিভিন্ন জাতের, বর্ণের, রঙের নানা রকম গাছগাছড়ার যে সংগ্রহশালা গড়েছিলন তা আজকের দিনের পরিকল্পিত সমৃদ্ধ বোটানিকেল গার্ডেনের কথাই মনে করিয়ে  দেয়।

এছাড়া জমিতে জৈবসার ব্যবহার, মানসম্মত বীজ ব্যবহারে অনুপ্রাণিত করা, জমির আইলে তথা পতিত জমি ব্যবহারে কৃষি ফলন বাড়ানো, সেচের মাধ্যমে জমি ফসল সেচ দেয়ার ব্যাপারে তিনি ব্যঞ্জরিত কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্র সময় থেকে এ যাবৎ বিশ্বখ্যাত একজন মানুষ কৃষির বাহিরের লোক হয়েও এত বেশি কাজ করেছেন এমন রেকর্ড আর নেই। আর হয়তো সে কারণেই রবীন্দ্রনাথ অনেক বড় মাপের মানুষ হিসেবে সুখ্যাতি পেয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথের কৃষিভিত্তিক সাহিত্যে কিছু নমুনা যাতে আপনারা বুঝতে পারবেন কৃষির প্রতি রবীন্দ্রনাথের আন্তরিকতা কতটুকু গভীর ছিল। তার মনোজগতে কৃষি কীভাবে মিশে গিয়েছিল একাকার হয়ে। ...অন্ধভূমি গর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান, প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ আদিপ্রাণ, ঊর্ধ্ব শীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা, ছন্দহীন পাষাণের বক্ষ-পরে আনিলে বেদনা নিঃসাড় নিষ্ঠুর মরুস্থলে...। ...হে বালক বৃক্ষ ...শ্রাবণ বর্ষণ যজ্ঞে তোমারে করিণু অভ্যর্থনা। থাকো প্রতিবেশী হয়ে, আমাদের বন্ধু হয়ে থাকো। ...রে মহুয়া নামখানি গ্রাম্য তোর, লঘূ ধ্বনী তার, উচ্চ শিরে তবু রাজকুল বণিতার, গৌরব রাখিস ঊর্ধ্বে ধরে...।

দেবদারু, আমবন, শেফালি নিয়ে বলেছেন...কেন সুদূর গগনে আছ মিলায়ে পবনে পবনে, কেন কিরণে কিরণে বলিয়া যাও শিশিরে শিশিরে গলিয়া... ওগো শেফালি বনের মনের কামনা...।...সারি দেয়া সুপারির আন্দোলিত সঘণ সবুজে, জোনাকি ফিরিতে ছিল অবিশ্রান্ত কারে খোঁজে-খোঁজে...।একটি কুর্চিগাছতার সমস্ত শক্তিতে বসন্তের জয় ঘোষণা করছে। উপেক্ষিত বসন্তের প্রতি তারএ অভিবাদন সমস্ত হট্টগোলে উপরে যাতে ছড়িয়ে ওঠে সে যেন তার প্রাণপণ চেষ্টা। কুর্চির সাথে এ আমার প্রথম পরিচয়...। কদমফুল...বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান...সহ আরও কত শত কৃষি বিষয় নিয়ে লিখেছেন।

...আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ার, লুকোচুরি খেলারে ভাই, লুকোচুরির খেলা। নীল আকাশে কে ভাসাল, সাদা মেঘের ভেলারে ভাই, সাদা মেঘের ভেলা...। আমার দেশের মাটির গন্ধে ভরে আছে সারাক্ষণ...কৃষি উন্নয়নে রবীন্দ্রনাথের অবদান অসামান্য এবং অনুসরণীয়। আমরা বরীন্দ্রনাথের সার্বিক অবদানের সাথে কৃষি উন্নয়ন তথা কৃষির বিকোশে যে অবদান রেখেছেন সে জন্য তারপ্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

...ফুলের বনে যার কাছে যাই তারে লাগে ভালো...ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধ সুধা ঢালো...চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে উছরে পড়ে আলো। আমরাও মানবতার সুগন্ধ ছড়াতে চাই মানুষের কল্যাণে। আমাদের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরোপুরি কৃষির কথাই বর্ণনা করেছেন সুন্দরভাবে।...ওমা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে...অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে কি দেখেছি মধুর হাসি...। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কৃষকের দোরগোড়ায় আধুনিক ও লাগসই কৃষি প্রযুক্তি পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারে যে বিষয়গুলো ভেবেছিলেন, সে ধারা অনুসরণ করেই কাজ করছেন আজ আমাদের কৃষি গবেষক ও সম্প্রসারণকর্মীরা। এর ফলে যথারীতি এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের কৃষি সেক্টর। সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশ। তাইতো আধুনিক কৃষির রূপকার হিসেবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজও আমাদের কাছে প্রাতঃস্মরণীয়।  

লেখক : উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।