পুরুষ নির্যাতন এবং প্রাসঙ্গিক ভাবনা


প্রকাশিত: ০৪:১৫ এএম, ১৪ আগস্ট ২০১৬

মাহবুব (ছদ্মনাম) সরকারি চাকুরে। বাবা-মায়ের বড় সন্তান এবং পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। মায়ের অসুস্থতার জন্য ছেলেকে বিয়ে দেয়া হয় এইচএসসি পাশ সুলতানার (ছদ্মনাম)  সাথে। বিয়ের পূর্বে ছেলে পক্ষকে কিছু জানানো না হলেও বিয়ের পরে মাহবুব যখন শ্বশুর বাড়ি যায়, তখন সে জানতে পারে তার সদ্য বিবাহিত বউ সুলতানা একাদশ শ্রেণিতে থাকাকালে এক সহপাঠীর সাথে ঘর থেকে পালিয়ে গিয়েছিল।

এক মাস পর পরিবার যখন ঘর থেকে পালিয়ে যাওয়া সুলতানার সন্ধান পায় তখন বরিশাল থেকে খুলনায় নিয়ে আসে। আর খুঁজতে থাকে সরকারি চাকুরি করা কোনো ছেলে। অবশেষে মাহবুবের সাথে সুলতানার বিয়ে হয় এবং সুলতানার প্রেম ঘটিত কাণ্ড বিয়ের পূর্বে সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়। বিয়ের দুই দিন পর শ্বশুর বাড়ি যেয়ে ফুপা শ্বশুরের কাছ থেকে মাহবুব যখন তার বউয়ের পুরানো ঘটনা জানতে পারে, তখনই ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এইবার সুলতানার বাবার আসল চেহারা ধরা পড়ল। তিনি মাহবুবকে জানিয়ে দেন, যদি সে সুলতানাকে ডিভোর্স দেয়ার চিন্তা করে তবে নারী নির্যাতনের মামলা দেয়া হবে। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বল্প বেতনে চাকুরে মাহবুব ভালো করেই জানে, মামলা হলেই চাকরি থেকে বরখাস্ত হতে হবে। সকল রাগ, অভিমান, কষ্ট নিজের মধ্যেই জমে থাকল।

রফিক (ছদ্মনাম) একজন ডাক্তারের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করে। মাস শেষে মাইনে ৭,০০০ টাকা। বিয়ে করে আসমা (ছদ্মনাম) নামের এক মেয়েকে। আসমা সপ্তম কিংবা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। বিয়ের সাত দিনের মাথায় আসমা বাবার বাড়ি যাবার পর আর স্বামীর বাড়ি আর আসেনা। পরে রফিক জানতে পারে একই গ্রামের নিকট আত্মীয়ের সাথে আসমার সম্পর্ক আছে। প্রায় ৬ মাস বাড়িতে না আসায় রফিক ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়। ভাগ্য তখন আরও নির্মম হলো। আসমার বাবা সাথে সাথে নারী নির্যাতন এবং যৌতুকের মামলা করল। প্রায় ৭০,০০০ টাকা খরচ করে সেই মামলার নিষ্পত্তি হয়। তবে আসমাকে তালাক দেয়া সম্ভব হয়নি। আসমা এখন মাসের ১৫ দিন স্বামীর বাড়ি আর বাকি ১৫ দিন বাবার বাড়ি থাকে। এভাবেই চলছে রফিক-আসমার সংসার।

উপর্যুক্ত দুইটি ঘটনা কোন গল্পের কাহিনী নয়। মাহবুব, রফিকের উপর কালবৈশাখী ঝড়ের মত প্রবহমান। বাংলাদেশের আইন এখনও নারীকূলের পক্ষে। সকল পরিবেশ, পরিস্থিতি বিবেচনায় সেটা থাকতেই পারে। কিন্তু অপব্যবহার রোধ করা প্রয়োজন। প্রতিহিংসার কারণে একজনের বিরুদ্ধে যখন মিথ্যা নারী নির্যাতন কিংবা যৌতুকের মামলা দেয়া হয়, তার প্রতিকার কিভাবে সম্ভব? বর্তমানে ‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে শ্লীলতাহানির মামলা’ খুবই আশ্চর্যজনক মনে হয়। সেচ্ছায় যখন সব হচ্ছে, তখন মামলা কেন? কেউ তো আর অবুঝ বয়সে অপকর্ম করছে না। এই ধরনের মামলার ক্ষেত্রে দুই জনেরই সাজা হওয়া উচিত। কারণ, শুরুই যেখানে অনৈতিক কাজ দিয়ে, সেখানে অপরাধী দুজনেই।

সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো, শ্লীলতাহানির মতো স্পর্শকাতর একটি বিষয়ের মাধ্যমে অন্য পুরুষদের যখন নাজেহাল করা হয়। গত ৩০ নভেম্বর, ২০১৫ তারিখ দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ এ প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ছিল “শ্লীলতাহানির মিথ্যা অভিযোগে মামালাঃ স্বামী-স্ত্রী কারাগারে” এবং খবরের বিষয়বস্তু ছিল নিন্মরূপ- আদালতের সঙ্গে প্রতারণা করে তিনজন নিরীহ মানুষকে শ্লীলতাহানির মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর দায়ে বাদী (সুমি আক্তার) ও তার স্বামীকে কারাগারে পাঠিয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের একটি আদালত। ট্রাইব্যুনালের পিপি জানিয়েছেন, কারাগারে বন্দি থাকা আসামিদের জামিনের শুনানি ছিল। এসময় বাদী সুমি আক্তার উপস্থিত হয়ে দরখাস্ত দিয়ে বন্দিদের জামিনে যেতে আপত্তি নেই বলে জানান। আদালতের সন্দেহ হওয়ায় তাকে মামলাটি কেন করেছিল জানতে চায়? জবাবে সে জানায় মামলাটি করেছিল তার স্বামীর নির্দেশে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই স্বীকার করে, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে এই মিথ্যা মামলাটি দায়ের করে। শ্লীলতাহানির বিষয়টাকে আমরা এত সাদামাটা করে ফেলেছি কিভাবে? এতটা অসভ্য আমরা কিভাবে হচ্ছি? এখানে প্রতিবেশি তিন যুবকের কপাল ভালো যে, সুমি আক্তার এবং তার স্বামীর শুভবুদ্ধির উদয় ঘটেছিল। আর সুমি আক্তার যদি মামলা প্রত্যাহার না করত, তবে প্রকৃত সত্য কখনও সামনে আসতো না।

নারী নির্যাতনের খবর, পরিসংখ্যানমূলক তথ্য আমরা মাধ্যমে পেয়ে থাকি। কিন্তু পুরুষ নির্যাতনের প্রকৃত তথ্য সেভাবে পাওয়া যায় না। সমাজে উচ্চ পদস্থ অনেক পুরুষই শুধুমাত্র স্ত্রীর কারণে নিজের বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিজের কাছে রাখতে পারছেন না। ঘরের মধ্যে কতদিন ঝগড়া ভালো লাগে। স্ত্রীর শত অভিযোগ থেকে রেহাই পাবার জন্য বাবা-মাকে আলাদা রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার মাস শেষে বাবা-মায়ের কাছে কত টাকা পাঠানো যাবে, সেই নির্দেশনাও স্ত্রী দিয়ে দিচ্ছেন। এছাড়া হাজার ধরনের কৈফিয়ত তো আছেই। চাকরি যতই নির্ধারিত বেতনের হোক, অনেক স্ত্রীর আবদার যেন সীমার মধ্যে নেই। শিক্ষিত সমাজে এই সমস্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষিত পুরুষগুলো সমাজে বিরাট পদ, পদবির ভারে নিজের সমস্যাগুলো কাউকে বলতেও পারে না। মনের মধ্যেই অশান্তি নিয়ে প্রতিটা মুহূর্ত বয়ে চলছে। এই সমস্যার সমাধান কোথায়? অনেক স্বামী যেমন প্রতারক, তেমনি অনেক প্রতারক স্ত্রী রয়েছে। অনেক স্বামী বিয়ের পূর্বে যেমন মিথ্যার আশ্রয় নেয়, অনেক স্ত্রীও বিয়ের পূর্বে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। তাহলে আইন কেন একপেশে হবে? পুরুষদের সহায়তার জন্য এখনও কোন ট্রাইবুনাল নেই। নির্যাতিত পুরুষটি কোথায় যাবে?  

পত্রিকায় খবর আসে, স্বামী কর্তৃক স্ত্রী হত্যা। এখন অবশ্য স্ত্রী কর্তৃক স্বামী হত্যাকাণ্ডও অহরহ ঘটছে। এক দুই দিনের বিরক্তি বা ক্ষোভে কেউ কাউকে হত্যা করতে পারে না। এই হত্যা হচ্ছে অনেক দিনের পুঞ্জীভূত রাগ বা ক্ষোভের ফল। যখন নিজের জীবনেরই কোন মূল্য থাকে না, তখনই বিপর্যয়গুলো ঘটে থাকে। মত পার্থক্যের প্রাথমিক পর্যায়ে যদি প্রত্যেকে আলাদা হবার সুযোগ পেত, তবে অনেক ক্ষেত্রেই এই সমস্ত ন্যক্কারজনক ঘটনাগুলো ঘটত না।

উন্নত দেশে লীভ-টুগেদারের যে সংস্কৃতি চালু আছে, অচিরেই আমাদের দেশেও সেই পরিবর্তন ব্যাপক আকার ধারণ করবে যদি বিবাহ বিচ্ছেদের প্রথা জটিল হয়। মনের মিল না হলে এক ছাদের নিচে থাকা কখনই সম্ভব নয়। পৃথিবীতে সবাই ধোয়া তুলশী পাতা নয়। দোষ গুণ সকলেরই আছে। সকলের জন্য সমান আইন থাকা উচিত। নারীকে নারী আর পুরুষকে পুরুষ হিসেবে বিবেচনা না করে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। আর পারিবারিক সমস্যা জনিত মামলা মোকদ্দমার কারণে সরকারী চাকুরেদের বরখাস্ত করা বন্ধ হওয়া উচিত। কারণ অনেকেই এটাকে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধীর তকমা লাগিয়ে তার রুটি রুজি বন্ধ করে দেয়া কখনও কাম্য হতে পারে না।

লেখক : কলামিস্ট
[email protected]

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।