বৈষম্যে বসবাস


প্রকাশিত: ০৫:৪২ এএম, ১৩ আগস্ট ২০১৬

যে ছেলেটি শহরে জন্ম নিয়েছে আর যে মেয়েটি সেই বস্তির পাশেই বিশাল অট্টালিকায় জন্মালো, তারা একই দেশের নাগরিক, একই শহরে বাস করে, কিন্তু তাদের মাঝে কতনা দূরত্ব। যদি বস্তির মেয়েটি জন্মাবার সময়ই মরে না যায় তবে তার বেঁচে থাকা সেই ছেলেটির মতো কখনোই হবে না। জীবনের প্রতিটি স্তরে মেয়েটি বড় হয়, আর শেখে সমাজ তাকে কি চোখে দেখে।

সুযোগের বিতরণ ব্যবস্থা আমাদের দেশে খুবই বৈষম্যমূলক। এই প্রভেদ আয়ে, সম্পদে, লিঙ্গে, এমনকি শহর আর গ্রামে। যা একসময় ছিল না, সেই ধর্ম বিভেদ এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় স্পষ্ট। আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেতর শক্ত করে গেঁথে দেয়া হয়েছে এই অসাম্যের বীজ। খুব ব্যতিক্রম না হলে গরীবের ঘরে জন্ম নেয়া প্রতিটি শিশু বড় হয় দরিদ্র হিসেবেই এবং মারাও যায় একই মর্যাদা নিয়ে।

আমাদের আগামীর বাংলাদেশের কথা যখন ভাবি তখন স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে এই সমাজ ব্যবস্থার কথা। সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদ নিয়ে আজ যে উদ্বেগ তার মূলে এই বৈষম্য। আমাদের উন্নয়ন হয়েছে অনেক। প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, মাথা পিছু আয় বেড়েছে। যেদিকে চোখ যায় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চোখে পড়ছে। তবুও কেন এমনটা হচ্ছে? সন্ত্রাস নির্ভর ধর্মাশ্রয়ী সহিংস রাজনীতির চর্চা যারা করে তাদের আশ্রয় প্রশ্রয় আছে। কিন্তু আরো কিছু কারণও আছে।

শুধুমাত্র উন্নয়ন আসলে সবকিছুর উত্তর নয়। উত্তর হবে বহুমুখি। জঙ্গিবাদ বলতে শুধুমাত্র সমাজে বিরাজমান হিংসার রাজনীতি এবং প্রতিশোধস্পৃহামূলক কার্যকলাপকে ধরলে হবে না, এই হিংসাপূর্ণ জঙ্গিবাদের সাথে যুক্ত আছে মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির কর্মকাণ্ড। নিপীড়িত মানুষের স্বার্থচিন্তা থেকে নিজেদের বহু দূরে নিয়ে গিয়ে যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চর্চা চলছে তার সাথে যুক্ত। নিবরাস, রোহান আর অর্কের মতো অতি ধনিক শ্রেণির তরুণকে বগুড়ার কোন এক অজ পাড়াগাঁয়ের চরম দরিদ্র পরিবারের তরুণকে কোন সে আদর্শ যে একই ছাদের নিচে নিয়ে আসতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর কেবলই উন্নয়ন নয়।

আর্থ-সামাজিক কারণগুলি হল অত্যাচার, বঞ্চনা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, পারস্পরিক আস্থার অভাব, প্রতিকূল পরিবেশে অবস্থান, শিক্ষার অভাব ইত্যাদি। নানাভাবে আমরা উপর থেকে উন্নয়ন চাপিয়ে দিয়ে ভেবেছি মানুষ সব গ্রহণ করছে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। শোষণ, অত্যাচার, বৈষম্য দূর করা, পারস্পরিক আস্থা জাগাতেতো পারেইনি, পারেনি সব শ্রেণির মানুষের মাঝে আত্মমর্যাদার বোধ তৈরি করতে। সন্ত্রাসবাদ যখন যাবতীয় রাজনৈতিক মতাদর্শ হতে বিযুক্ত হয়ে পড়ে, তখন জঙ্গি হামলার লক্ষ্য হয়ে উঠে চমকপ্রদ ও নাটকীয় অ্যাকশন। গুলশান হামলাও তাই। এসব নানা ধরনের অনিয়মের মাঝে যে দল ও গোষ্ঠি সবসময় সুযোগ নিতে চায় অস্থিরতা তৈরির তারা জাল ফেলে ধনি, দরিদ্র নির্বিশেষে তরুণদের এক জায়গায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছে।

গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলায় অংশে নেয়া পাঁচ তরুণের তিন জনই সচ্ছল পরিবারের সন্তান। লেখাপড়া করেছে বেসরকারি স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারা বিশেষ সুবিধাভোগী এবং বাংলাদেশ ও বিদেশে শিক্ষিত। সন্ত্রাসীদের জন্য আমরা যে প্রোফাইল তৈরি করেছি, তা হল অনেকটা এ রকম: তারা গরিব, গ্রামের ছেলে, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। কিন্তু আর্টিজানে হামলাকারীদের ক্ষেত্রে এই ধারণা বদলে দিয়েছে। দেখলাম মাদ্রাসা শিক্ষার্থী আর বড়লোকের দেশ-বিদেশ পড়া সন্তান একই আদর্শকে বেছে নিয়েছে।

এখন রাষ্ট্র, তার নানা প্রশাসনিক শাখা, শিক্ষাঙ্গন সব জেগে উঠেছে এই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। এটা শুভ লক্ষণ। কিন্তু একটা মতাদর্শ ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার চেষ্টা এবং তা করতে সন্ত্রাসীদের নিয়োগ দেয়ার যে প্রক্রিয়া তার মোকাবেলা খুব সহজ নয়। ধনি পরিবারের তরুণকে বোঝানো হচ্ছে পশ্চিমা কর্তৃত্ব, আন্তর্জাতিক রাজনীতি আর দরিদ্র পরিবারের তারুণযকে শেখানো হচ্ছে স্থানীয় ধর্মীয় জিঘাংসার দর্শন।

সরকার নিরাপত্তার শৈথিল্যগুলো দূর করতে পারে, ছিদ্রসমূহ বুজাতে চেষ্টা করতে পারে। প্রতিটি শহরের ব্যস্ত, জনবহুল এলাকাসমূহ ক্লোজ-সার্কিট ক্যামেরা মারফত নজরদারি এবং রুটিন-বহির্ভূত যে-কোনও গতিবিধি চ্যালেঞ্জ করতে পারে। নজরদারি-ব্যবস্থাটি ঠিকঠাক চালু আছে কি না, তার উপর নজর রাখাও জরুরি। সর্বোপরি, ঘরোয়া ভাবে অর্থাৎ প্রায় কুটিরশিল্পের সহজিয়া পথে বোমা বা বিস্ফোরক বানাবার সুবিধাগুলোও সঙ্কুচিত করা দরকার।

সরকার সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টা সর্বতোভাবে বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। অতীতের যে কোনও সহিংস আন্দোলনের মতো আজকের জঙ্গি কর্মকাণ্ডও প্রতিহত করা যেতে পারে, কিন্তু সেটা খুব সহজ নয়। এ কাজে সরকারকে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। জনগণের দিক থেকে এখন আর এসব বৈষম্যের বিরুদ্ধে কোন কিছু তেমনভাবে উচ্চারিত হয় না। আমাদের নির্বাচন সমূহেও এসব কোন ইস্যু নয়। তাই শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার হয় না। এক প্রাথমিক স্তরেই বহু ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি থাকায় নানা ধরনের মানসিকতায় বেড়ে উঠছে প্রজন্ম।
 
সকলের জন্য সমান না হোক, কিন্তু সুযোগ, এটুকু নিশ্চিত করা না গেলে, দখল আর দুর্নীতির উৎসব চলতে থাকলে, বৈষম্যকে সঙ্গী করে প্রবৃদ্ধি হতে থাকলে, মানুষ সেখানে নিজেকে বিযুক্ত ভাবতে থাকে, অংশীদারী হয় না। দেশে আয়বৈষম্য, সম্পদের মালিকানায় বৈষম্য, বিভিন্ন সেবাপ্রাপ্তিতে বৈষম্য এত প্রকট যে তা সাদা চোখেই দেখা যায়। দেশের গড় আয় বেড়েছে; কিন্তু আয়বৈষম্যের কারণে সমাজে এর তেমন প্রতিফলন নেই। যে খাতগুলোর মাধ্যমে এই প্রবৃদ্ধি ঘটছে, তার বেশিরভাগ রয়েছে মূলত ধনী বা অবস্থাপন্ন ব্যক্তিদের অধিকারে। দরিদ্রদের নিজেদের সম্পদের পরিমাণ সামান্য। তাই আয় বৃদ্ধি ও উচ্চ প্রবৃদ্ধির সুফল তারা পাচ্ছে না।
   
মাথাপিছু আয় অবশ্যই বিচারের একমাত্র মাপকাঠি নয়। আদর্শ অবস্থায় দেখা উচিত মানব উন্নয়নের বিভিন্ন দিক, কারণ সেটাই তো আয়বৃদ্ধির আসল লক্ষ্য। আইনের শাসন, উন্নয়নের উপযোগী পরিকাঠামো এবং সামাজিক সম্পদ ও পরিবেশ না থাকলে জঙ্গি মোকাবেলা কঠিন কাজ। সন্ত্রাস ও রক্তক্ষয় যে বাংলাদেশকে নত করতে ব্যর্থ তা প্রমাণ করতে হবে এসবে নজর দিয়ে এবং সবাইকে সাথে নিয়ে।

syed-Ishtiaque-Reza

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।