‘‘পুলিশ আছে বইলাই রাতে কাউরে ডরাই না’’
মঙ্গলবার নাইট রাউন্ড ডিউটি ছিল। নগরবাসী যাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে, এই লক্ষ্যে আমার মতো পুলিশের হাজারো সদস্য তখন ডিউটি করছিল। আমার কাজ ছিল রমনা বিভাগের ৬ থানার নাইট ডিউটির পুলিশ সদস্যদের খোঁজখবর নেয়া। কাজের তদারকি করা, প্রণোদনা দেয়া। তবে নাইট ডিউটিতে রাউন্ডের সময় অন্যভাবে ঢাকাকে দেখার সুযোগ হল। রাতের ঢাকার নিস্তব্ধতায় হাজার হাজার গল্প লুকিয়ে ছিল। সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি গল্প চোখে পড়লো। একজন পুলিশের চোখে রাতের সেই নিস্তব্ধ ঢাকা নগরীর প্রতিচ্ছবি নিয়েই আমার লেখা।
ঘড়িতে তখন রাত ২টা। বাইরে হালকা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। সাথে ঠাণ্ডা একটা হাওয়া। ফুরফুরে মেজাজে গাড়িচালক রহমতকে সাথে নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। ফরেইন একাডেমি থেকে সোজা গেলাম মৎস্য ভবনের দিকে। সেখানে দেখলাম আমাদের পুলিশ সদস্যরা টহল গাড়িতে বসা। আমাকে দেখে ছুটে এলেন এসআই হুমায়ূন কবির। প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ দিয়ে গাড়িতে উঠতে যাওয়ার সময় চোখ আটকে গেল একজন পান বিক্রেতাকে দেখে। কাছে গেলাম। দেখলাম শুধু পান নয় সাথে সিগারেটও আছে। নাম বাবুল মিয়া। বাড়ি কিশোরগঞ্জে। বৃষ্টির কারণে নিজে ভিজে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু পলিথিন দিয়ে পরম মমতায় ঢেকে রেখেছে ওর এই ছোট পসরাটিকে। বললাম, এতো রাতে বেচা-বিক্রি করেন ভয়-ডর লাগে না? হাসতে হাসতে বাবুল মিয়া উত্তর দিলেন, ‘পুলিশ ভাইরা আছে না, হেরা তো আমগোর ভাই, হেরা আছে বইলাই তো রাতে কাউরে ডরাই না।’ এরকম একজন মানুষের পুলিশের প্রতি যে আস্থা ও ভালোবাসার ধরন দেখে মুগ্ধ হলাম।
‘অরে আমরা ঠিকি ওর বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমুনে’
বৃষ্টি একটু দম নিয়েছে বুঝলাম। গাড়ির জানালাটা খোলা। শীতল একটা বাতাস জুড়িয়ে দিচ্ছে শরীরটাকে। আকাশে ঘন কালো মেঘ। এরকম একটা পরিবেশে রাতের এই নগরীতে ঘুরতে ভালোই লাগছে। এ মুহূর্তে ‘কাজল লতা’ ছবির ‘এই রাত ডাকে, ওই চাঁদ ডাকে, আজ তোমায় আমায়’ গানটি খুব মনে পড়ছে। গাড়ি শাহবাগ পার হয়ে যাচ্ছে বাংলামোটরের দিকে। বসুন্ধরা শপিংমলের সামনে তিনটি ছোট ছেলেকে দেখে দাঁড়ালাম। তিনজনই কম বয়সী। সবার ছোটটির নাম দিয়াজ। ওর সাথে মামুন ও কামাল। এতো রাতে না ঘুমিয়ে ঘোরাঘুরির কারণ জিজ্ঞেস করতেই মামুনের কাছে মিলল আসল তথ্য। জানলাম, ছয় বছর বয়সী দিয়াজ একা একা বাড়িতে যেতে ভয় পাচ্ছে। ওর বাড়ি মগবাজারের দিকে। ও ঘোরাঘুরি করছিল শমরিতা হাসপাতালের সামনে। ওকে এভাবে ঘুরতে দেখে মামুন আর কামাল ওকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলো। জানলাম, মামুন আর কামালেরও কেউ নেই। ওরা দুজন কাজ করে কাঁচামালের একটা আড়তে। ও কি হয় তোমাদের? ওকে তোমরা পৌঁছে দিতে পারবে?- ‘হে আমগো কিছুই হয় না, আবার ধরেন ছোট ভাইয়ের মতো, আমরা বয়সে বড়, আমগো একটা দায়িত্ব আছে না, আপনে চিন্তা কইরেন না, অরে আমরা ঠিকি ওর বাসায় পৌঁছে দিয়া আমুনে।’ এই বাচ্চা ছেলেগুলোর এরকম মহানুভবতা আর দায়িত্ববোধ মুগ্ধ করল আমাকে। শিখলাম অনেক কিছু। রাত তখন সাড়ে ৩টা। বসুন্ধরা শপিংমলে সামনের টহল টিমকে ওদেরকে গাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বিদায় নিলাম। গাড়ি ছুটে চলল রাসেল স্কয়ারের দিকে।
ভিক্ষা কেন করবো? যতদিন শরীর চলবো, কাজ কইরাই খাবো।
রাসেল স্কয়ারে এসে দেখি একেবারে সব জনশূন্য। একজন লোকও নেই। শুধু পুলিশের টহল গাড়ির পাশে একজন বৃদ্ধ রিকশাচালককে দেখলাম। বৃষ্টির জন্য হুড তুলে পা উঠিয়ে রিকশার মধ্যে চুপ মেরে বসে আছেন। হয়তো যাত্রীর জন্য এই অপেক্ষা। আমাকে উনার দিকে আসতে দেখে নিজেই নামলেন রিকশা থেকে। সালাম দিলাম। ভালো করে তাকালেন আমার দিকে। জানতে চাইলাম, আজকে কতো আয় হয়েছে?- ‘না বাবা আমরা বুড়া মানুষ, কেউ উঠতে চায় না, সবাই ভাবে আমদের গায়ে শক্তি নাই। তাই ইনকাম নাই। আজকে রাত ১২টার সময় বের হইছি, মাত্র আশি টাকা পাইছি।’ কথাগুলো বলার সময় দেখলাম তার চোখ ছলছল করছে। পরে শুনলাম লোকটার নাম ইউসুফ আলী। বাড়ি চাঁদপুরের হাইমচর। ঢাকায় রায়েরবাজারে বেড়িবাঁধে একটা খুপড়ি ঘরে থাকেন পরিবার নিয়ে। হাইমচরে পদ্মার করাল গ্রাসে সব বিলীন হয়ে গেছে তার। বললেন, ‘বয়স মেলা আমার। আর শরীর চলে না। রিকশার প্যাডেল ঘুরাতে মন চায় না। মাঝখানে ভাবছিলাম ভিক্ষা করবো, কিন্তু আমি ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ছি, একটা মূল্য আছে না, ভিক্ষা কেন করবো? যতদিন শরীর চলবো, কাজ কইরাই খাবো ‘ এরকম মূল্যবোধ নিয়ে যিনি আজ জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে দাঁড়িয়েছেন, তাকে আর একবার সম্মান জানাতে ভুল করিনি। মনে মনে বললাম, চাচা আমরা সবাই যদি আপনার মতো মূল্যবোধ ধারণ করতে পারতাম?
‘স্যার এটা কোন কষ্টই না, আমরা এটাকে ইবাদত মনে করি’
ঘড়িতে রাত ৪টা ছুঁইছুঁই। এবার গন্তব্য ধানমণ্ডি লেকের আট নম্বর ব্রিজ। ওয়ারলেস সেটে ওই এলাকার দুটো টহল দলকে ওখানে আসতে বললাম। একটু পরেই ওখানে আসলো ওরা। একটা এসআই রবিউলের অপরটা এএসআই আব্দুল বারীর টিম। দেখলাম সবাই বেশ ক্লান্ত। দুজন কনস্টেবলের চোখে ঘুম ঘুম ভাব। রাত ৮টা থেকে ডিউটি শুরু করেছে ওরা। চলবে সকাল ৮টা পর্যন্ত। ছয় ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে বেলা ২টা থেকে আবারও কাজ শুরু করবে ওরা। কনস্টেবল দুজনের পাশে গিয়ে বললাম, খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না? অবাক করে দিয়ে ওরা আমাকে বলল, ‘স্যার এটা কোন কষ্টই না, আমরা এটাকে ইবাদত মনে করি, সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে, আমরা পাহারা দিচ্ছি, এটাই আমাদের কাছে খুব আনন্দের, এটা ভাবলে আর কোনো কষ্টই মনে আসে না।’ শাবাশ বলে ওদের পিঠ চাপড়ে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিলাম। ততক্ষণে আবার গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঘড়ির কাঁটা তখন ৪টা বেজে সাড়ে ৪টার দিকে এগিয়ে চলেছে।
‘হ দায়িত্ব তো সবার, কিন্তু পালন করে কয়জন’
গাড়ি ছুটছে জিগাতলা হয়ে স্টার কাবাবের দিকে। রাত শেষ। সকাল হতে আর দেরি নেই। স্টার কাবাব সামান্য পার হতেই সামনে তিনজন লোককে দেখে গাড়িচালক রহমতকে গাড়ি থামানোর নির্দেশ দিলাম। পাশে গিয়ে জানলাম, ওরা সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছনতা কর্মী। হাবিব, ইউনুস, আর বাচ্চু। তিনজনই হাতে লোহার কাঁটা দিয়ে ময়লা-আবর্জনাগুলো একটা টুকরির মধ্যে নিয়ে সেগুলো ময়লার ট্রাকে তুলে দিচ্ছে। এতো রাতে এই বৃষ্টির মধ্যে কষ্ট করে কাজ করছেন কীভাবে? হাবিব হেসে বলেন, ‘কাজ করতে তো কষ্ট হইবই, এই শহরটা পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব তো আমাগরই। কাম না করলে তো পুরা শহরডাই ময়লায় ভইরা যাইবো।’ বললাম এটা শুধু কী আপনাদের দায়িত্ব, আমাদের না? এবার ইউনুস মুখটা নিচু করে বলে উঠলেন- ‘হ দায়িত্ব তো সবার, কিন্তু পালন করে কয়জন, সবাই তো যেখানে খুশি ময়লা-আবর্জনা ফেলে, কারো তো হুঁশ নাই, জান যায় আমগোর।’ ওই তিন পরিচ্ছন্নতা কর্মীর এমন কথা শুনে লজ্জা পেলাম। মনে মনে ভাবলাম ভুল করেও আর কোথাও ময়লা-আবর্জনা ফেলব না। এই ঢাকা মহানগরীকে সুন্দর, নিরাপদ ও বাসযোগ্য করার জন্য রাতের ঢাকায় কতো মানুষ যে কাজ করে আমরা কেউ তার হিসেব রাখি কী? এই মানুষগুলোর অবদান অন্য জীবিকার মানুষদের চেয়ে অনেক বেশি। আজ রাতে আমার পুলিশ সদস্য, ওই দায়িত্ববান ছেলে দুটো, বৃদ্ধ রিকশাচালক চাচা, নগরীর পরিচ্ছন্নতা কর্মী সবার দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ আর মূল্যবোধের শাণিত ধার দাগ কাটলো আমার মনে। আমি নতুন করে উজ্জীবিত হলাম।
ভোর ৬টা। আকাশ অনেকটা মেঘমুক্ত। ঝকঝকে। তবে মিষ্টি একটা বাতাস আছে। প্রাণভরে শ্বাস নিলাম। অফিসে এসে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘কি মিষ্টি, দেখ মিষ্টি, কী মিষ্টি এ সকাল’ গানটা শুনতে শুনতে চেয়ারে বসে একটু চোখ বুজলাম।
লেখক: সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার, মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশনস, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ঢাকা।
এইচআর/এবিএস