ছেলেটির নাম রোমান্স, মেয়েটির নাম প্রেমী


প্রকাশিত: ০৪:০৫ এএম, ০৭ আগস্ট ২০১৬

দ্বিতীয় সন্তান হবার পর প্রাইমারি স্কুলের দপ্তরি বাবা মসজিদের হুজুরকে দুপুরে দাওয়াত করে এনে অনেক আলোচনা করার পর ছেলের নাম ঠিক করলেন মোঃ বরকত আলম। ছোটবেলা থেকেই বরকত লেখাপড়ায় ভালো হবার কারণে সবাই তাকে স্নেহ করত। স্টার মার্কস নিয়ে এসএসসি করায় গ্রামের মধ্যে হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল। উচ্চ মাধ্যমিকে উপজেলার কলেজে ভর্তি হলো। ভালো রেজাল্টের জন্য কলেজে সকলের মধ্যমণি ছিল। বিষয়টি বরকত উপভোগ করত। যাই হোক, অনেক ভালোলাগার মাঝে নিজের নামটা তার কাছে বড্ড সেকেলে মনে হত। দেরি না করে নিজের নামটা বদলে রাখল ‘রোমান্স’। খুব তাড়াতাড়ি ‘রোমান্স’ নামেই সে কলেজে পরিচিত হয়ে উঠল।

গ্রাম থেকে স্টার মার্কস নিয়ে এসএসসি পাশ করার পর কুলসুম আক্তার শহরের কলেজে ভর্তি হলো। অল্পের জন্য বোর্ডস্টান্ড হয়নি। শহরের চাকচিক্য তার খুব মনে ধরে যায়। সব কিছুই ভালো লেগে যায়। সে লক্ষ্য করল, ক্লাসের অনেক ছেলে মেয়ের মধ্যে ভাব জমে গেছে এবং সে গ্রাম থেকে আসায় যেন অন্যদের থেকে পিছিয়ে আছে। সবার কত সুন্দর সুন্দর নাম! তাই বেশি দেরি না করে কুলসুম আক্তার তার নামটি পরিবর্তন করে ‘প্রেমী’ নামে সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠল। এরপর থেকেই প্রেমীর কাছে মনে হল, ক্লাসের সবাই তাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কেউ কেউ প্রেমের প্রস্তাবও দেওয়া শুরু করল।

মোঃ বরকত আলম এবং কুলসুম আক্তার কেউ কারো পরিচিত নয়। কিন্তু কিছু জায়গায় তাদের মধ্যে অনেক মিল ছিল। ছোটবেলা থেকেই তারা ডাক্তার হবার ইচ্ছা নিয়েই পড়ালেখা করত। দুজনেই প্রাইমারি এবং জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল। তারা দুজনেই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে খুব ভালো রেজাল্ট করে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। দুজনেই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। দুজনেই কলেজে ভর্তি হয়ে তাদের মূল উদ্দেশ্য ভুলে অন্য স্রোতে ভেসে বেড়াতে চেয়েছিল। সর্বশেষ মিল- উচ্চ মাধ্যমিকে দুজনেই অকৃতকার্য। বর্তমানে বরকত আলম একটি শাড়ির দোকানের কর্মচারী এবং কুলসুম আক্তার পরিপাটি গৃহিণী। দুজনেই এখন বাবা-মায়ের দেয়া নামে পরিচিত।

শুধু নাম পরিবর্তনের কারণে তারা উচ্চ মাধ্যমিকে ফেল করেছিল, সেটা বলব না। তবে নাম পরিবর্তন ছিল ব্যর্থতা শুরুর একটা উপসর্গ। মনোবিজ্ঞানী ই. হারলকের মতে, বয়ঃসন্ধিকালের ব্যাপ্তিকাল ১২ থেকে ২১ বছর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে ২৮ মিলিয়ন কিশোর আছে। এর মধ্যে ১৩.৭ মিলিয়ন মেয়ে এবং ১৪.৩ মিলিয়ন ছেলে। আর কিশোরদের ব্যাপক অংশই শিক্ষার্থী। তাই লেখাপড়াই হওয়া উচিত তাদের প্রধান ব্রত। কিন্তু সেটা হচ্ছে কোথায়?

এই বয়সে ছেলেমেয়ে উভয়েই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ বোধ করে। কখনো কখনো প্রেমের সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়ে এবং হতাশা ও কষ্ট হতে মুক্তি পেতে বহুতল ভবনের ছাদ হতে লাফিয়ে পড়ে, গলায় দড়ি দিয়ে, ঘুমের ওষুধ খেয়ে এবং বিষপান করে আত্মহননের পথও বেছে নেয়। তারা নিঃসঙ্গ বোধ করে এবং আত্মসচেতন, ভাবপ্রবণ ও অন্তর্মুখী হয়ে ওঠে। অনেক কিশোর মনে করে,  পরিবার তাদের উপযুক্ত মর্যাদা দিচ্ছে না। কোনো কোনো সময় পরিবারের সদস্যদের বকাবকির কারণে কিশোররা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। অনেক সময় মা-বাবার আদেশ-উপদেশকেও গ্রাহ্য করতে চায় না। ফ্যাশন সচেতন হয়ে ওঠে। হঠাৎ করে রেগে যায়। নির্ঘুম রাত কাটায়। ঠিকমতো খেতে চায় না। কখনো কখনো হতাশা কাটাতে মাদকদ্রব্য, ফেসবুক, ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়ে। ফলে পড়ালেখার চরম অবনতির পাশাপাশি পুরো জীবনটাই সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ভেঙে যায় একটি পরিবারের স্বপ্ন। ধ্বংস হয়ে যায় সম্ভাবনাময় একটি কিশোরের জীবন।

সকল কিশোরদের উদ্দেশ্যে বলব, আপনারা মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে হেঁটে বড় হয়েছেন তাদের মতো হবার স্বপ্ন দেখুন। দশ জনের একজন হবার স্বপ্ন আপনাকেই দেখতে হবে। কেউ আপনাদের ভালোবাসা, শাসন দিয়ে সঠিক পথে নিয়ে আসবে, এমন ধারণা থেকে বেরিয়ে আসুন। স্বার্থপরের মত নিজের ভালো মন্দ বুঝতে শিখুন। আমি দুরন্তপনার বিপক্ষে নই। কারণ এগুলোই জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি হয়ে থাকে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মূল কাজ লেখাপড়া। সেটা বাদ দিয়ে অন্যকিছু যেন মুখ্য না হয়ে ওঠে। একজন শিক্ষার্থী যখন তার লেখাপড়া থেকে সরে দাঁড়ায়, তখন সে শুধু নিজের ক্ষতিই করে না, একই সাথে পরিবার, সমাজ এবং দেশেরও ক্ষতি করে। শত প্রলোভন শত দিক থেকে আসবে। কিন্তু আমাদের কিশোররা লক্ষ্য থেকে কখনই বিচ্যুত হবে না, এই সংকল্প তাদের নিজেদের মধ্যেই তৈরি করতে হবে।

লেখকঃ উপপরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।