এ শহরে নিজেকে ভালোবাসাও অপরাধ!

হাবীবাহ্ নাসরীন
হাবীবাহ্ নাসরীন হাবীবাহ্ নাসরীন , কবি ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৪:০৯ এএম, ০৪ আগস্ট ২০১৬

অফিস শেষে চটপটি খেতে গিয়ে কথা হচ্ছিল সহকর্মীর সঙ্গে। বললেন, আজ রাতে মাওয়া যাচ্ছি, ইলিশ খেতে। বললাম, আর কে যাচ্ছেন? ভাইয়া জানালেন, বিকেলের শিফটের সবাই যাচ্ছেন। অফিসের গাড়িতে যাবেন। তাই ফেরা নিয়ে দুশ্চিন্তাও নেই। বললাম, আমিও একদিন যাবো আপনাদের সঙ্গে। বলে নিজেই হেসে ফেললাম। কারণ আমি বুঝতে পেরেছি, কী অসম্ভব কথাই না আমি বলে ফেলেছি! আমি একজন নারী। অফিসে অন্য সবার মতো আমিও কাজ করি। মাস শেষে বেতন তুলি। কিন্তু এই এক জায়গায় এসে আমি আলাদা।

চাইলেই আমি রাতের বেলা আমার সহকর্মীদের সঙ্গে ইলিশ খেতে যেতে পারি না। ভাইয়া বললেন, তুমি ছেলে হলে কোনো সমস্যা ছিল না, এ শহর তো মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়, রাতের বেলা তো আরো নয়। মনে মনে ভাবলাম, শুধু মেয়েদের কেন, এ শহর তো অনেক ছেলের জন্যও নিরাপদ নয়। নইলে আমার যে ছোট ভাইটি, ফাহিম, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, সে কেন আমাকে নক করে বলবে, আপু, অনেক কষ্টে এক মাসের জন্য একটি বাসা ভাড়া নিতে পেরেছি, এক মাস পরেই ছেড়ে দিতে হবে, নতুন বাসা খুঁজতে হবে, দোয়া করো। আরেকটু পর আবার নক করে বলে, আপু, জঙ্গিরা কি রিকশায় হুড খোলা রেখে হাওয়া খেতে খেতে চলাফেরা করে? বললাম, আমি কী করে জানবো জঙ্গিরা কী করে চলাফেরা করে! বললো, একটু আগে রিকশায় হুড ফেলে হাওয়া খেতে খেতে যাচ্ছিলাম। এক পুলিশ মামা আমাকে থামিয়ে শুধু প্যান্ট ছাড়া বাকি সবকিছু খুলতে বললো। জুতা, মোজা কিছুই বাকি রাখেনি। কী বিড়ম্বনা বলো তো আপু! বললাম, এসব তো আমাদের নিরাপত্তার জন্যই করা হচ্ছে। পুলিশ তো আর জানে না তুমি জঙ্গি কি না। তুমি যে জঙ্গি নও, সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্যই তো এতসবকিছু করেছে। ইতিবাচক হও ভাই, জাস্ট এনজয় ইট! ছেলেটিকে তো সান্ত্বনা দিলাম। কিন্তু দেশের কর্তাব্যক্তিরা কি সত্যিই আমাদের নিরাপদ রাখতে পারছেন?
 
নিরাপত্তার নামে হয়রানি তো আর এ শহরে নতুন কিছু নয়। হয়রানির শিকার তো আরো কতভাবেই কতজন হচ্ছেন। সবটার খবরও তো আমরা রাখি না। সামান্যতম নাগরিক সুবিধা থেকেও আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। বিশেষ করে মেয়েরা। রাস্তায় চলতে গিয়ে হঠাৎ হয়তো বৃষ্টি এলো। সঙ্গে ছাতা আছে অথবা নেই। বৃষ্টির তোড় এতটাই যে আমাকে কোনো ছাউনির নিচে দাঁড়াতে হবে। আমি কোথায় দাঁড়াবো? শহরের বেশিরভাগ যাত্রীছাউনিই বেদখল। ফুটপাথ বেদখল। হাঁটতে গেলেও মানুষে মানুষে ধাক্কা লেগে যায়, এমন অবস্থা। অথবা ধরুন একজন মেয়ে, ধরুন আমিই, আমি কোথাও যাচ্ছি। পথে যদি কোথাও আমার ওয়াশরুমে যাওয়ার দরকার পড়ে, আমি কোথায় যাবো? পাবলিক টয়লেটগুলোতে যাওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই। জীবনে একবার দুর্ভাগ্য হয়েছিল এই শহরের পাবলিক টয়লেটে যাওয়ার। সেই অভিজ্ঞতা এতটাই ভয়াবহ যে সেখান থেকে বের হয়ে মনে হয়েছিল, এরপর থেকে যে-ই নারী অধিকার নিয়ে বড় বড় লেকচার দেবে- আমরা হ্যান করেছি, ত্যান করেছি, তাকে অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও পাবলিক টয়লেটে এনে রাখতে হবে। আশা করি লেকচার বন্ধ হয়ে যাবে।

একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি, তখন আমি দশম শ্রেণিতে, মফস্বল শহরে থাকতাম। বিকেলবেলা বাসা থেকে কিছুটা দূরে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে যেতাম। আর তখন আমার সঙ্গে যেতো আমার প্রতিবেশি আট বছরের একটি ছেলে। সে আমার সঙ্গে যেতো কারণ, একা আমাকে পেয়ে যদি কোনো বখাটে কিছু বলে বা পিছু নেয়। আট বছরের সেই ছেলেটি, মাহমুদ, সে আমার নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজ করতো! ষোল বছরের মেয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে আট বছরের ছেলে! আমাদের শহরগুলোর নিরাপত্তার চিত্র অনেকটা এরকমই! এতদিনেও বদলায়নি সেই চিত্র। সম্প্রতি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের একটি সাহিত্য উৎসবে যাওয়ার নিমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়েছি। কারণ, এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে যাওয়ার মতো আমার কোনো নিকটাত্মীয় বা পরিচিতজন নেই। তাই আমি একা, সাহিত্য উৎসবে যোগ দিতে পাশের দেশটিতে যেতে পারিনি। না। কেউ আমাকে বলেনি, তুমি যেতে পারবে না। কিন্তু আমার চারপাশটা আমার এমনভাবে পরিচিত যে সেই পরিচিত পরিবেশটাই বলছে, তুমি যেতে পারবে না।

এ শহরে একা মেয়ের নিরাপত্তা দেয়ার কেউ নেই। তাই নিজেকেই নিজের নিরাপদ রাখতে হয়। লোকাল বাসগুলোর কথা নতুন করে লিখতে গেলে বিরক্ত হবেন অনেকেই। এ শহরের বাসগুলিতে নারীদের কী পরিমাণ ভোগান্তিতে পড়তে হয়, তা কারোরই অজানা নয়। শুধু নারীদের বলছি কেন, বাসে উঠতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েননি এমন পুরুষও তো নেই। পুরুষদেরই যেখানে ভোগান্তিতে পড়তে হয়, নারীর ভোগান্তির চিত্র তো সেখানে আরো ভয়াবহ! শতাব্দি নামের একটি মেয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বাসের কথা বলেছিল। পরের দিন তার জন্য বাস এসে দাঁড়িয়েছিল সঠিক স্টপেজে। সেই কাহিনি সবগুলো মিডিয়া কতো গর্ব করে প্রকাশ করেছিল। শতাব্দি সাহসী কন্যা, শতাব্দিরাই পারবে। কিন্তু কেউ কি জানেন, সেই শতাব্দির জন্য বাস এখনও যায় কি না? কেউ কি জানেন, প্রতিদিন পথে পথে এমন কতশত শতাব্দি দাঁড়িয়ে থেকে বাসের জন্য অপেক্ষা করে, অপেক্ষা করে একটু নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোর?

যখন বৃষ্টি হয়, খুব ইচ্ছা করে সঙ্গের ব্যাগ, ছাতা সব ছুঁড়ে ফেলে বৃষ্টিতে ভিজি। তবে তা কল্পনাতেই সম্ভব। বাস্তবে এ শহর আমার বৃষ্টিতে ভেজার জন্য নয়। একা ঘুরে বেড়ানোর জন্য নয়। যদি কখনো একা কোনো রেস্টুরেন্টে খেতেও যাই, বাকি সবাই কেমন করে যেন তাকায়! যেন আমার কেউ নেই তাই একা একা খাচ্ছি। যেন একা খেতে যাওয়াটাও একটা অপরাধ। সঙ্গে পুরুষ না থাকলে এ শহরের নারীরা পরিপূর্ণ নয় যেন! নিজেকে নিজে একবেলা ট্রিট দেয়া যায় না। এ শহরে নিজেকে ভালোবাসাটাও এক ধরনের অপরাধ!

লেখক : কবি, সাংবাদিক

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।