যে প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি এখন


প্রকাশিত: ০৫:২৩ এএম, ২৭ জুলাই ২০১৬

যে কোনো বিশ্লেষকের মতেই পৃথিবী একটি ভয়ঙ্কর দুঃসময় অতিক্রম করছে, তা তিনি যে কোনো দেশ বা যে কোনো ভাষার বিশ্লেষকই হোন না কেন। মূলকথাটি সকলেই এভাবে বলতে চাইছেন যে, আর কিছুই নয়, পৃথিবী আক্রান্ত হচ্ছে মানবতাবিহীন এক অপশক্তির দ্বারা। বিশেষ, করে একে একটি নির্দিষ্ট ধর্মে বিশ্বাসীদের ওপর যারা দোষ চাপিয়ে বিপদমুক্ত হতে চাইছেন তারা কেবল এই সত্যটি আড়াল করছেন যে, এটি কেবল একটি ধর্মবিশ্বাসীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সংঘাতের ফলাফল নয়, বরং এর একটি বৃহৎ পরিসর রয়েছে। কেউ কেউ একে ব্যাখ্যা করতে চাইছেন, পুঁজিবাদের কালো দিক হিসেবে এবং মানুষের ভোগ-লালসা-ক্ষমতালিপ্সার দম্ভ ও তার পরিণতি হিসেবে। কিন্তু যেভাবেই দেখা হোক না কেন, পৃথিবী যে একটি সংকটকাল অতিক্রম করছে তাতে কারোরই দ্বিমত নেই এবং এই সংকটকেই কেউ কেউ একটি বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি হিসেবেও বর্ণনা করছেন।

কিন্তু হঠাৎ করেই বিশ্বের এই উত্তাল হওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে কি বিশেষ কোনো কারণ আছে? একটি স্থায়ী কারণ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে সৃষ্ট অস্থিরতার কথাতো রয়েইছে, সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়া এবং বিগত দশকে চীন-রাশিয়া-ভারত এই তিনটি রাষ্ট্রের ক্রমশ: শক্তিশালী হয়ে ওঠা ও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার বিষয়টিও উঠে আসছে। বিজ্ঞানীদের মতে, ভূ-পৃষ্ঠকে আজকের অবস্থায় আসতে বহুবিধ অবস্থা পার হয়ে আসতে হয়েছে, বরফ যুগ, পাথর যুগ ছাড়াও পৃথিবীর অভ্যন্তরে নিরন্তর বিস্ফোরণ অন্তে ক্রমশঃ পৃথিবী আজকের রূপটি ধারণ করেছে। এখনও পৃথিবীর অভ্যন্তরে যেমন প্রকৃতি নিজেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চলছে সব সময় তেমনই পৃথিবীর উপরিতলে মানুষও একের পর বিস্ফারন্মোখ পরিস্থিতির জন্ম দিয়ে চলেছে। গণতন্ত্রকে যেমন বহু বন্ধুর পর পার হয়ে আজকের পরিণতি পেতে হয়েছে তেমনই একথাও এখন আলোচনায় উঠে আসছে যে, পৃথিবীর এই অস্থিরতার অন্তেও হয়তো বিশেষ কোনো সুখবর থাকতেই পারে। মোটকথা, এই চিন্তাভাবনার পক্ষের মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়।

সেক্ষেত্রে যারা এরকম ইতিবাচক ভাবে আজকের এই দুর্দিনকে দেখছেন, তারা মূলত: কী বলতে চাইছেন? তাদের বলার কথা এটাই যে, আজকের পৃথিবীতে চলমান এই সমস্যার পেছনের মূলে রয়েছে মূলত: ধর্ম। বিশেষ করে সবচেয়ে নবীনতম ধর্মটি অর্থাৎ ইসলামের আধিপত্য সৃষ্টির তীব্র আকাঙ্খা। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, এর আগে খ্রিস্টান ধর্ম পৃথিবীর ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার যে কৌশল অবলম্বন করেছিল ইসলামও সে পথেই এগুচ্ছে। খ্রীস্টধর্মের ইতিহাসের প্রথম এক হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, দিকে দিকে ধর্ম দিয়ে রাষ্ট্র জয় করার অজস্র উদাহরণ কিন্তু রোম থেকে উড়ে আসা নির্দেশের শিকার হওয়া রাষ্ট্রসমূহ ক্রমশঃ খ্রীস্ট ধর্মের এই আধিপত্য মানতে অস্বীকার করতে শুরু করে ধর্মটির বয়স এক হাজার বছর হওয়ার আগেই। আর ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে আলাদা করার মাধ্যমে যে গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদের উত্থান ইউরোপে ঘটেছে তার ফল হিসেবে আমরা হয়তো একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব পেলেও পেতে পারতাম। প্রশ্ন হলো, সেরকমটি হলেতো পৃথিবীর টিকে থাকাটাই মুস্কিল হতো, কেননা, শান্তি সংঘাতের সূত্র মতে, যুদ্ধই হলো শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রথম ও একমাত্র পথ। এবং যুদ্ধের অনুপস্থিতিই যে শান্তি নিশ্চিত করে না, সেটাও বেশ একটা আলোচিত মতবাদ পাশ্চাত্যের শিক্ষা ব্যবস্থায়।

এসব কঠিন বিষয় আজকের লেখায় উদ্ধৃত করার মূল লক্ষ্যই হলো বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির পরিণতি সম্পর্কে আলোকপাত করা। এবং বিষয়টি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেমন সে বিষয়টিও খানিকটা ছুঁয়ে যাওয়া। কারণ, বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রের বাইরের কোনো দেশ নয়। বরং ভৌগোলিক ভাবে বাংলাদেশ এমন একটি অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে যেখান থেকে বৈশ্বিক রাজনীতির অনেক বড় ঘটনার সূত্রপাত ঘটানো সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ভারত ও চীনের মতো নব্য বৃহৎ শক্তিদ্বয়ের নিকটবর্তী  রাষ্ট্র হওয়ায় এই দুই রাষ্ট্রের শত্রুপক্ষের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম। এর সঙ্গে যদি যোগ ঘটানো যায়, যে রাষ্ট্রটি ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম, উপমহাদেশে সেই পাকিস্তানের অপতৎপরতা, তাহলে বাংলাদেশের অবস্থানকে ব্যাখ্যা করায় খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এছাড়াও কথা রয়েছে। সেই কথাটি হলো, বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু নাগরিকের ধর্মটিও যে ইসলাম, এই সত্যও কোনো ভাবেই দেশটির পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব নয়।

ধর্মকে আশ্রয় করে যে বা যারাই রাষ্ট্র ক্ষমতার দখল চায় তাদের জন্য এদেশে অবারিত সুযোগ রয়েছে বলে আমর বরাবর লক্ষ্য করেছি। আর ধর্মকে ব্যবহার করে বর্তমান বিশ্বে নতুন ধরনের যে রাজনীতিটি স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তীকালে শুরু হয়েছে তা থেকেও বাংলাদেশকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সুতরাং সব দিক বিবেচনায় মধ্যপ্রাচ্যে যে ধর্মভিত্তিক অপশক্তির জন্ম ঘটেছে কিংবা কারো কারো মতে, সৃষ্টি করানো হয়েছে (পাঠক আশা করি বুঝতে পারছেন, আমি এখানে সুস্পষ্ট ভাবেই আইসিস-এর কথাই বলছি), সেই আইসিস-এর নজর বাংলাদেশের দিকে পড়াটা কোনো ভাবেই অস্বাভাবিক নয়, কারণ এখানে রয়েছে সংখ্যাগুরু মুসলমান এবং এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে একটি মৌলিক প্রশ্নে বিভাজন, প্রশ্নটি হলো, আপনি প্রথমে একন বাঙালি? নাকি একজন মুসলিম? সত্তরের দশকে একজন বাঙালি মুসলমান নিজেকে প্রথমে বাঙালি পরিচয় দিয়ে পাকিস্তানের নিগড় থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে জীবন বাজি রাখতে দ্বিধা করেনি। কিন্তু এখন এই পরিবর্তিত বিশ্বে এসে একজন বাঙালি মুসলমানের পক্ষে খুব সহজে নিজেকে প্রথমে বাঙালি পরিচয় দেওয়ার সুযোগটি খর্ব হয়েছে।

কেন এমনটি হয়েছে তা এক কথায় উত্তর দেওয়ার মতো বিষয় নয়, তবে মোটা দাগে বলতে গেলে, যে কোনো রাষ্ট্রই যখন জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীনতা অর্জনে সফল হয় তখন কিছু বছর অতিক্রম করার পর জাতিগত ভাবেই সেই চেতনাকে আর ধরে রাখা সম্ভবপর হয় না। সেখানে আরো অনেক নতুন ও জটিল প্রশ্নেরা এসে ভিড় করে, সেই ভিড় ঠেলে আত্মপরিচয় সন্ধান করা ঠিক সম্ভব হয় না, যদি না পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নাগরিকের জন্য কেবলমাত্র এই কারণেই বরাদ্দ দেয়া থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যের মতো দেশেও জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ধরে রাখতে ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোকে একটি শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থেকেই কেবল টিকে থাকতে হয়নি, তার চেয়েও বড় কথা হলো, এই সব রাষ্ট্রগুলোকে একটি স্যোশাল ওয়েলফেয়ার রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হয়েছে। কোনো রাষ্ট্রই কিন্তু স্বীকার করবে না যে, এই স্যোশাল ওয়েলফেয়ার সিস্টেমটি আসলে তাদের চিরশত্রু কমিউনিজমেরই শিক্ষা।

সে যাহোক, বাংলাদেশে এখন যে দৈত্যটি আমাদের অস্তিত্বের ওপর আঘাত হানছে তারা নিজেদের যতোই বাইরের অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যে তৈরি হওয়া ব্রহ্মদৈত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে জাহির করার চেষ্টা করুক না কেন, কিংবা বাংলাদেশের মুখ দিয়ে এই সম্পর্কের বিষয়টি নিশ্চিতভাবে স্বীকার করিয়ে নেওয়ার জন্য যতোই চাপ প্রয়োগ করা হোক না কেন, তাতে মূল্য সত্য বদলাবে না, আর এক্ষেত্রে মূল সত্য হচ্ছে, বাংলাদেশের ভেতরেই তৈরি হয়েছে রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধর্মাক্রান্ত করতে ব্যর্থ হওয়াদের ভেতর তৈরি হওয়ার অপরিমেয় ক্ষোভ। একথা মোটেও অমূলক নয় যে, বাঙালি ধর্মভীরু কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। কিন্তু একথাও সত্য যে, ধর্মভীরুতা ও ধর্মান্ধতার মধ্যে পার্থক্য খুব সামান্যই। বিশেষ করে যখন ধর্মকে আক্রান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক পক্ষটি, ঠিক তখনই একজ ধর্মভীরু মানুষও ধর্মান্ধ হয়ে উঠতে পারে, বাংলাদেশে এরকম উদাহরণ অসংখ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চারদিকে। আগেই যে কথাটি বলেছি, বাঙালি আগে নাকি মুসলিম আগে, এই মৌলিক প্রশ্নটি নিয়ে বাংলাদেশে কোনো পক্ষই কাজ করেনি। এমনকি যে বামপন্থী দলগুলো নিজেদেরকে উদার ও সেক্যুলার রাজনৈতিক শক্তির প্ল্যাটফরম হিসেবে মনে করে তারাও কোনোদিন এই প্রশ্নটি নিয়ে দলীয় সহকর্মী ও সদস্যদের সামনে দাঁড়াননি। যে প্রশ্ন উচ্চারণে দেশের কেউই কোনোদিন গা করেনি এখন সেই প্রশ্নটিই যখন মুখ্য হয়ে ওঠে উত্তর খোঁজার জন্য, তখন স্বাভাবিক ভাবেই তার কোনো উত্তর রাতারাতি বের করা সম্ভব হয় না। এই প্রশ্নেরই বাই প্রোডাক্ট হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সর্বত্র বলা হচ্ছে, কেন এইসব কচি কচি ছেলেমেয়েরা জঙ্গি হচ্ছে?

কোনো কোনো পণ্ডিত(?) বলতে চাইছেন যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র নাই, কথা বলার অধিকার নেই সেজন্য হঠাৎ এরকম জঙ্গিদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তাদেরকে যদি পাল্টা প্রশ্ন করা হয় যে, আমেরিকায়তো গণতন্ত্র আছে, গণতন্ত্র আছে ফ্র্রান্সে, সেখানে কেন এরকম ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনা ঘটছে? তারা এর উত্তর দিতে পারেন না। আবার কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেন যে, যেহেতু ওরা গরীব ও অবহেলিত সেহেতু ওদেরকে ধর্ম দিয়ে বশ করা হচ্ছে। প্রশ্ন এখানেও আছে, হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীদের মধ্যে কি গরীব নেই? নেই খ্রীস্টান বা বৌদ্ধ ধর্মে? কই সেখানেতো কোনো জঙ্গি তৈরি হচ্ছে না, যারা দেশকে আক্রমণ করে রাষ্ট্র ক্ষমতার দখল চাইছে? এরকম বহুমাত্রিক প্রশ্ন এখন সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে। এটা একদিকে ভালো, যেকথা আগেই বলেছি। হয়তো প্রতিটি বিস্ফোরণেরই একটি বিপরীত দিক রয়েছে, সেখানে কোনো “ভালো” লুক্কায়িত থাকলেও থাকতে পারে। কথা হলো, সেই ভালোটুকু মানুষের জন্যতো? কারণ, মানুষই যদি না থাকে তাহলে “ভালো” দিয়ে কী হবে?

লেখাটি এখানে শেষ করে দিতে পারি, কিন্তু বলার কথা বা যা বলতে চেয়েছি তা আসলে কিছুই বলা হয়নি। এ বিষয়ে আরো একটি লেখা লিখতে চাই, আগে থেকেই পাঠকের কাছে সে অনুমতি নিয়ে আজকের মতো কথামালার ইতি টানছি।

ঢাকা ২৬ জুলাই, মঙ্গলবার২০১৬

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
masuda. [email protected]

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।