প্রবাসীদের সুখ-দুঃখ


প্রকাশিত: ০৪:০২ এএম, ২৬ জুলাই ২০১৬

শাহিন (ছদ্মনাম) চার বোনের একমাত্র ছোট ভাই। বাবার একটি ছোট চায়ের দোকানের আয়ে অভাব অনটনে চলত তাদের সংসার। খুব ছোট থাকতেই আল-আমিন বাবাকে চায়ের দোকানে সাহায্য করত। কিন্তু সংসারের অভাব অনটন যাচ্ছিল না। ২০০৭ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে কাজের জন্য বাহরাইন চলে যায়। বেতনের প্রায় সবটুকুই দেশে পাঠিয়ে দেয়। বাবা-মা এখন একটা ভালো বাসায় থাকে। বাবাকে আগের মতো দোকান চালাতে হয় না। দেশে সংসার এখন ভালই চলছে।

কিন্তু এই আটটি বছর কেমন কাটছে বাহরাইনে আল-আমিনের সময়? সারাদিন কাজের পর, বাড়তি কিছু আয়ের জন্য সাধ্যমতো ওভারটাইম করে। রান্নার কাজ থেকে শুরু করে ঘরের সব কাজ নিজেকেই করতে হয়। খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে সবকিছু। কিন্তু মনের মধ্যে কষ্ট অন্য জায়গায়। গত আট বছরে ষোলটি ঈদ গেছে। মাত্র দুই বার ঈদ-উল-ফিতরের সময় বাবা-মায়ের সাথে ঈদ করার সুযোগ পেয়েছিল। দেশে যে চলে আসবে, সে সুযোগও নেই। বাবা-মাকে প্রতিমাসে সে যে টাকা পাঠায়, ভালো ভাবে সংসার চালানোর জন্য প্রায় সবকিছুই খরচ হয়ে যায়। পরিবারের সবাইকে ভালো রাখতে বিদেশে থাকার কোন বিকল্প শাহিনের হাতে নেই।

দুই.
২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রবাসীরা এক হাজার ৫২৮ কোটি (১৫ দশমিক ২৮ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছেন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এক হাজার ৫৩১ কোটি ডলারের রেমিটেন্স দেশে এসেছিল। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে আসা রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৪২২ কোটি ডলার। ২০১২-১৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল এক হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার। বিদেশে নানা সমস্যা সত্ত্বেও প্রবাসীদের কল্যাণে রেমিটেন্স প্রবাহের পরিমাণ ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদের মতে, ‘প্রবাসী বাংলাদেশীদের আয়ে বাংলাদেশ চলছে বলা চলে। প্রবাসীদের পাঠানো বছরের ১৫ বিলিয়ন ডলার না হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির কী অবস্থা হতো, তা ভাবতেও ভয় লাগে। আজকে আমাদের অর্থনীতি বছরে ৭ শতাংশ করে প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বলে আমরা সবাই আশাবাদী হচ্ছি সেটাও এ কারণে যে আমাদের প্রবাসীদের পাঠানো আয় বাড়তে থাকবে, এবং অর্থনীতি আপন গতিতেই একটা মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যাবে।’

তিন.
প্রবাসীদের নিয়ে ফেসবুকে সংযুক্ত একটি বার্তা শেয়ার করা প্রয়োজন মনে করছি। যেখানে প্রবাসীদের সাথে দেশে অবস্থিত আত্মীয় স্বজনের জীবনযাত্রার মানের তুলনা করা হয়েছে- ‘এরা সেই লোক যাদের কাছে কিছু দিন পর পর আমরা দামী মোবাইল চেয়ে থাকি। অথচ এরা একটি কালার ডিসপ্লে মোবাইল দিয়ে কাটিয়ে দেয় বছরের পর বছর। এরা সকাল ৫ টায় কাজের জন্য বের হয়। আর আমরা ঠিকই সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমাই। এরা সেই লোক যারা সকালের নাস্তা ভুলে গিয়ে পলিথিনের ব্যাগে করে খাবার নিয়ে যায়। আর আমরা সাহেবের মতো নাস্তা করি খাবার টেবিলে বসে।  এরা সেই লোক যারা ৫০ ডিগ্রি রোদের মধ্যে কাজ করে, বিশ্রামের জন্য যাদের ঠাঁই হয় খেজুর গাছের নিচে বালুর মধ্যে। আর আমরা ঠিকই এসি, ফ্যান চালিয়ে আরামে বিশ্রাম নিয়ে থাকি। এরা বিকেলে রুমে আসতে গাড়িতে উঠার জন্য তিনশত গজ লম্বা লাইন ধরে দাড়িয়ে থাকে । আর আমরা গাড়ি ভাড়া করে বাড়িতে আসি।

এরা সেই লোক যারা মৃতব্যয়ী হয়ে কষ্ট করে বাড়িতে টাকা পাঠায়। আর আমরা বাবুগিরি করে টাকা উড়াই। এরা সেই লোক, যারা একবার অসুস্থ হলে ডাক্তারের ভিজিট যাবে বাংলার দুই হাজার টাকা এবং সাথে আরও কত টাকার ঔষধ, এই চিন্তা করে আল্লাহর উপর ভরসা করে বসে থাকে। আর আমাদের পেটে ব্যথা হলে ঠিকই ভালো ডাক্তারের কাছে যাই। এরা সেই লোক যারা অতি কষ্টে দিন কাটালেও বাড়িতে কাউকে বুঝতে দেয় না, যে এরা কষ্টে আছে। আর তাদের কাছে আমাদের চাহিদার শেষ নেই। তবু এরা শত কষ্ট বুকের মধ্যে জমা রেখে আমাদের সুখী রাখতে চায়।’

চার.
হাসান (ছদ্মনাম) পরিবারের সচ্ছলতার জন্য এইচএসসি পাশ করার পর সিঙ্গাপুর চলে যায়। ওয়েল্ডিং এর কাজ করে ভালই চলছিল তার চাকরি। প্রতি মাসেই নিজের খরচের টাকা রেখে বাকি টাকা মায়ের কাছে টাকা পাঠাত। ছয় বছর পার হয়ে যায়। একটি বারও দেশে আসা হয়নি। তবে কোন মাসেই টাকা পাঠাতে দেরি হয়নি। এর মধ্যে হাসানের হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস ধরা পড়ে। দেশে চলে আসে। দুঃখ যেন মাতৃভূমিতেই অপেক্ষা করছিল। তার মায়ের কাছে পাঠানো টাকা তিনি পরিবারের ব্যয়ের জন্য কিছু রেখে বাকি টাকা হাসানের ভগ্নিপতির কাছে দিত। হাসানের ব্যাংক হিসাবে জমা দিতে। কিন্তু ভগ্নিপতি সেটা না করে নিজের নামেই সকল টাকা জমা রেখেছে। অনেক শালিস বিচার করেও হাসান একটি টাকাও ফেরত পায়নি। ছয়টি বছরের সকল পরিশ্রমের ফলাফল একটা বড় শুন্য। হায়রে আত্মীয়! এমন আত্মীয় না থাকাই যে ভালো।

পাঁচ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে দেখা যায়, ৫৭ ভাগ পরিবার প্রবাস আয় থেকে প্রাপ্ত অর্থ বিনিয়োগ করেন না। সেই হিসেবে ২০১৫ সালে ৭২ হাজার ৪৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে শুধু ভোগ্যপণ্য ব্যয়ে। বাকি ৪৩ শতাংশ পরিবারের প্রায় পুরোটাই, ৭৪.৭৮ শতাংশ ব্যয় করে দালান কোঠা নির্মাণ, ফ্ল্যাট বা জমি কেনায়। অর্থাৎ বিনিয়োগ করা পরিবারগুলো যে অর্থ ব্যয় করছে তাতে অর্থনীতিতে টাকার আনাগোনা বাড়লেও মানুষের কাজের সুযোগ বা কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। বৃদ্ধি পাচ্ছে পরিবারের আরাম আয়েসের মাত্রা। অথচ যে মানুষটি দিন রাত পরিশ্রম করে দেশে অর্থ প্রেরণ করছে, সে যখন দেশে আসবে সে হয়ত তার জন্য সঞ্চিত কিছুই দেখতে পাবে না।

পরিবারের সুখ, সমৃদ্ধি এবং সচ্ছলতার কথা চিন্তা করে প্রবাসীরা দেশে আসারও সাহস করেন না। অথচ মন যে পরে থাকে তার প্রিয়জনদের কাছেই। যাদের স্বজন প্রবাসে অবস্থান করছে, তাদের প্রত্যেকটি পরিবারের উচিত একটু হিসেব করে খরচ করা। ছোট ছোট ব্যবসায় বিনিয়োগ করা। সেটা মুদি দোকানও হতে পারে। আর যদি তা সম্ভব না হয়, প্রবাসীদের নামে ব্যাংকে টাকাগুলো জমা রাখা। কারণ আজ যে মানষটি প্রবাসে অবস্থান করছে, সবসময় সে প্রবাসে থাকবে না। এক সময় দেশে আসবে। তার আর্থিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা পরিবারের অন্য সদস্যদের করতে হবে। কারণ সে তার সারাটা জীবন পরিবারের সদস্যদের জন্যেই ব্যয় করেছে।

লেখকঃ উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
 [email protected]

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।