দ্বীপ জ্বালা রাত জানি আসবে আবার


প্রকাশিত: ০৫:৩৯ এএম, ২৩ জুলাই ২০১৬

হঠাৎই যেন থমকে গেলো আমাদের জীবন! চারদিকে উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা, ভীতি, সন্দেহ, অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা মানুষের স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনকে কি এক দুর্বিষহ যন্ত্রণায় বিপন্ন করে তুলেছে। অন্য কিছু নয়, শুধু জীবনকে টিকিয়ে রাখতেই আমাদের সকলের এখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। কাউকে ভালোবাসতে, করুণা অথবা সহমর্মিতা দেখাতেও মানুষ এখন ভীত এবং আতঙ্কিত। কি জানি কি হয় ! কার ভেতরে কি দুরভিসন্ধি আছে কে জানে। এই বুঝি প্রাণটাই যায়।

দেশের তারুণ্য আজ বিপথগামী, বিপর্যস্ত উল্টোরথের ভেলায়। যে তারুণ্য আমাদের প্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কথা ছিলো, সেই তারুণ্যই আজ আমাদেরই হন্তারক। মায়ের আদর, দেশপ্রেম, কিশোরীর ভালোবাসা, নজরুল, ক্ষুদিরাম, জীবনানন্দ, সুকান্ত, রবিঠাকুর অথবা ভূপেন হাজারিকার একটি গানও তাদের জাগাতে পারেনি। ধর্মীয় জুজুর অজানা রহস্যময় বাঁশির সুরে সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেন রহস্যময় এক হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার অদ্ভুত সুরে পিছু হেঁটে হারিয়ে যাচ্ছে।

সারা বিশ্বে তরুণ জঙ্গিরা যখন অহরহ হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে ঠিক তখনই আমাদেরই আরেক তরুণ দল ক্যান্সারে আক্রান্ত একজন সঙ্গীত শিল্পীর জীবন বাঁচানোর জন্যে হাত পেতেছেন দেশবাসীর কাছে। তাই মনে হচ্ছে আমরা এখনো শেষ হয়ে যাইনি। সব কিছু ভেঙে পড়েনি এখনো। পেরুবার আরও অনেক পথ বাকি রয়েছে। আছে অনেক কিছু করার। আছে ভালোবাসা, আছে প্রত্যয়, আছে একজন কাছের প্রিয় মানুষের দুঃসময়ে পাশে থাকার দায়বদ্ধতা। তবে এমনটি চাননি আত্মমর্যাদাশীল শিল্পী লাকী আখন্দ। তাই প্রথম দিকে খুব কাছের কয়েকজন মানুষকে তার পাশে থাকার কথা বললেও দেশবাসীর কাছে সাহায্য চাওয়ার বিষয়টি তিনি মর্যাদাকর মনে করেননি। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে একজন মানুষের নিজের জীবন বাঁচানো কি কারো করুণা প্রার্থনা করা না অধিকার?

Lakiবেঁচে থাকা প্রতিটি মানুষের একটি মৌলিক ন্যায্য অধিকার। তবে শিল্পীরা স্বভাবসুলভ ভাবে আবেগপ্রবণ ও আত্মমর্যাদাশীল মানুষ। জীবনের বাস্তবতার হিসাব নিকেশ এদের আপ্লুত করে না। কারণ তাদের শিল্প সত্ত্বায় প্রতিদিনের চাল নুন তেলের হিসাব থাকে না। থাকে প্রেম, আবেগ ভালোবাসা। যা বন্ধন ও দায়বদ্ধতার সেতু নির্মাণ করে বর্তমানের সাথে ভবিষ্যতের। জাতীর এই দুর্যোগে বর্তমান আর ভবিষ্যতের এই সেতুবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা আমরা এখন পলে পলে অনুভব করছি। মানুষ হয়ে একটি তুচ্ছ কারণেই খুব সহজেই জীবন নিয়ে নেয়া যায়, কিন্তু একটি মৃতের প্রাণ মানুষের ফেরানো অসম্ভব । তবে আমরা পারি নিভে যাওয়ার আগেই একটি প্রদীপের দ্বীপ জ্বেলে রাখতে। মুছিয়ে দিতে জীবনের আঁধার। আর তার জন্য প্রয়োজন সহমর্মিতা, ভালোবাসা, সৃষ্টিশীল শিল্পের প্রতি শ্রদ্ধা এবং যথাযোগ্য মর্যাদা। সঙ্গীত এবং শিল্পী আমাদেরই জাতীয় সম্পদ। আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্যর ধারক। গানের মধ্যে দিয়ে শিল্পীরা যুদ্ধ করে আবার এর মাধ্যমেই মানুষ মানুষকে ভালোবাসে, আবেগাপ্লুত হয়।

’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ গানটি আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ জয়ে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলো। আজ এই ক্রান্তিলগ্নে আমরা যেন তারুণ্যকে রক্ষা করার ঠিক তেমনি একটি যুদ্ধেই অবতীর্ণ হয়েছি। যে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার একমাত্র মারণাস্ত্রের নাম ভালোবাসা। আর ঘুণে ধরা সমাজের অবক্ষয় রোধের এক অনবদ্য যোদ্ধা হচ্ছেন একজন শিল্পী এবং তাঁর সৃষ্টি। বাংলাদেশের সজ্ঞীতকে যারা একদিনের জন্যও ভালোবেসেছেন তাঁরা লাকী আখন্দের এই নীল মনিহার, আবার এলো যে সন্ধ্যা, আমায় ডেকো না গানগুলো শোনেননি এবং এসব গান শুনে আবেগের ভেলায় ভাসেননি এরকম মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া কঠিন ।

বাংলাদেশে তাঁর অসংখ্য, অনবদ্য সৃষ্টি গান যুগ যুগ ধরে টিকে আছে অগণিত রুচিশীল মানুষের কণ্ঠে, মননে । যে গান আজও মানুষ একান্তে গুন গুন করে। ভাবতে কষ্ট হচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য আজ সেই কালজয়ী সুরস্রষ্টাকেও করুণা ভিক্ষা করতে হচ্ছে। এই চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করার ক্ষমতা তাঁর নেই। তবে আপনার সাহায্যের হাত বাঁচিয়ে দিতে পারে তাঁর কণ্ঠকে। যে কণ্ঠ নতুন প্রজন্মকে আবার ভালোবাসতে শেখাবে। তাঁর প্রতি করুণা করে নয়, এটি আমাদের প্রতি তাঁর অধিকার। সে অধিকার ঋণ শোধ করার। বন্ধুরা, স্বর্ণালী দিনে যে নীল মনিহার লাকী ভাই ভালোবেসে আমাদের দিয়েছিলেন তা মনে রেখে কি একটু শ্রদ্ধা আর সহানুভূতির হাত বাড়ানো যায় না?  

লেখক : কলামিস্ট
[email protected]

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।