বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি


প্রকাশিত: ০২:০২ এএম, ২৩ জুলাই ২০১৬

তরুণরা হারিয়ে যাচ্ছে, অনেকেই নিখোঁজ হয়ে জঙ্গি দলে নাম লেখাচ্ছে। যারা জঙ্গি হচ্ছে তাদের একটা বড় অংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে বা পড়তো। এমন একটি খবরে, দেশবাসি আজ উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত। সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে সবাই যখন ভাবছে তখন আরো এক উদ্বেগজনক খবর উপস্থিত সবার সামনে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় ছাত্ররাজনীতি শুরুর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ভাবটা এমন যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি থাকলেই এসব ক্যাম্পাসে জঙ্গি উপদ্রব কমে যাবে। বিষয়টি কি এতই সরল?

ছাত্রদের রাজনীতি করা উচিত কিংবা উচিত নয়, এনিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। এবং স্বীকার করতেই হবে আমাদের ছাত্ররাজনীতির অতীত বেশ উজ্জ্বল। ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন এবং নব্বই এর গণআন্দোলনে ছাত্র-জনতার লড়াই আমাদের ইতিহাসের অংশ। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে ছাত্ররাজনীতির আজ যে চরিত্র, তাতে ক’জন ক্যাম্পাস নিয়ে স্বস্তি বোধ করে? সন্ত্রাস, উপদলীয় কোন্দল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিনির্ভর ছাত্ররাজনীতির বিষফল আজ দেশের শিক্ষার পরিবেশকে বিষিয়ে তুলেছে।

গণতান্ত্রিক দেশে গণতান্ত্রিক চেতনা তৈরি ও অধিকার রক্ষার জন্যই ছাত্ররাজনীতির যথেষ্ট গুরুত্ব। কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলে। দেশের পাবলিক বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই ছাত্ররাজনীতির হাত ধরে শিক্ষক রাজনীতিও এমন এক পর্যায়ে এসেছে যে তা নিয়ে সমাজের নানা স্তরে সমালোচনা আছে। এই ছাত্ররাজনীতি আর ভেতর থেকে শিক্ষক রাজনীতির খেলোয়াড়দের উৎসাহে কতনা মাননীয় উপচার্য অপমানিত হন, লাঞ্ছিত হন, কতনা পড়ালেখার সময় নষ্ট হয়, কত তরুণকে জীবন দিতে হয়!

দলীয় ঝান্ডার ছাত্ররাজনীতি কত শতাংশ শিক্ষার্থী পছন্দ করে? খুব একটা যে করে না, তা মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পরই বোঝা যায়। প্রায় সব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী গণমাধ্যম কর্মীদের জানান তারা ছাত্ররাজনীতির বর্তমান যে অসুস্থ ধারা তাকে ঘৃণা করেন। তাহলে বলতেই হয় পছন্দ করেন বা জড়িত থাকেন খুব অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী। সেই সামান্য সংখ্যক শিক্ষার্থীর রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে চরিতার্থ করার মূল্য দিতে হচ্ছে অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে, অধ্যাপক-অধ্যাপিকা ও শিক্ষক কর্মচারীদের।

রাজনীতির নামে, রাজনীতির আসকারায় বহু ন্যক্কারজনক এবং নিন্দনীয় আচরণ করে ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা। তার নজির ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমান ছাত্ররাজনীতি ক্ষমতার লড়াইয়ের, ভাগাভাগির ও সহিংস, যা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভয়ঙ্কর হবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জঙ্গি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তার সমাধান কি ছাত্ররাজনীতি যার রূপ এদেশের মানুষের খুব চেনা? এক ভয়ংকর প্রবণতাকে ঠেকাতে আরেক ভয়ংকরের আগমন কেমন পরিস্থিতি তৈরি করবে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে?  

এই প্রশ্নগুলো উঠছে, কারণ সরকারি কলেজে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের নামে, পেশিশক্তির জোরে অছাত্রসুলভ কত আচরণ নিয়তই প্রদর্শিত হতে দেখছে মানুষ। যে যে কারণে আন্দোলন, তা বহুক্ষেত্রেই কার্যকারণহীন হয়ে যায়। এমনকি তুচ্ছ অনৈতিক কারণেও ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা তৈরি করছে, উপাচার্যদের ঘেরাও করছে, তাঁদের সঙ্গে অসভ্যতা করছে, শিক্ষকদের অসম্মান করছে। এরকম নানা নজির স্থাপন করে ছাত্ররাজনীতির নেতাকর্মীরা ক্রমেই প্রমাণ করছেন, তারা এক দেউলিয়া মানসিকতা নিয়ে রাজনীতি করেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। জঙ্গিবাদের বিস্তার হওয়ায় যে পরিবর্তন আমাদের সামনে উপস্থিত তাকে কেন্দ্র করে চিন্তা-বিনিময় এবং আলোচনার সুযোগ এসেছে। সেই সুযোগকে যেকোন কিছু দিয়ে নষ্ট করা ঠিক হবে না।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য আদর্শ নাগরিক তৈরি করা। সেখানে দেশের প্রতি ভালবাসা-দায়িত্ব-কর্তব্য যেমন থাকবে, তেমনই নিজের এবং পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর তাগিদও থাকবে। এই দুইয়ের ভারসাম্য রক্ষা পেলেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য সফল হয়। তাই শিক্ষার সঙ্গেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগাতে হবে। বয়সের সঙ্গে এই চেতনা পরিণত হবে। রাজনৈতিক চেতনা জাগাবার অর্থ কোনও দলের ঝান্ডা ধরা নয়। ছাত্রসমাজ অপরিণত বুদ্ধিসম্পন্ন এবং আবেগপ্রবণ। তাদের সহজেই নতুন মতাদর্শে দীক্ষিত করা যায় এবং ত্যাগের মাধ্যমে বড় কাজ করানো যায়। আবার লোভ দেখিয়ে বিপথগামীও করা যায়। প্রথম ব্যবস্থায় ছাত্রসমাজকে রাজনৈতিক চেতনায় দীক্ষিত করা যায়। রাজনীতি আর দলীয় রাজনীতি যে এক নয়, সেটাই আমাদের ছাত্র রাজনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতি আছে, যখন যে সরকার থাকে, শুধু সেই দলীয় ছাত্র সংগঠনের একক প্রভাব থাকে। সেখানে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা একেবারে নেই বললেই চলে। আর নেই বলেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না বহু বছর ধরে। দেশে স্বৈরাচার হটিয়ে গণতন্ত্র আনতে ভূমিকা রেখেছে ছাত্র সমাজ, কিন্তু নিজের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে পারেনি সেই নব্বইয়ের পর। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ক্ষেত্র বিশেষে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও আজ জঙ্গি আদর্শ বেড়ে উঠায় যে সংকটের মুখোমুখি, সেই সংকটের সামনে দাঁড়িয়েই এই সমস্যার বিশ্লেষণ করতে হবে। একটি অব্যবস্থাপনা আরেকটি খারাপ দাওয়াই দিয়ে সমাধান করা যাবে না।

ছাত্র রাজনীতির পক্ষে এখনো অনেক যুক্তি আছে। কিন্তু তাহলো সুস্থ ধারার রাজনীতি। সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজি সংস্কৃতির রাজনীতি নয়। ছাত্র আন্দোলন গৌরবময় অতীতের পাতায় ফিরবে এমন প্রত্যাশা করা যাচ্ছে না। দলীয় নিয়ন্ত্রণ ভেঙে, দলীয়-আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, ছাত্র-ঐক্য অর্জনের লক্ষ্যে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সক্রিয়তার প্লাবণ আদৌ যদি আনা যায় তাহলে সেটাই হবে নতুন ধরনের রাজনীতি।

এককভাবে যদি ছাত্রলীগ তার আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে, তাহলে এসব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নতুন করে সংকটে পড়বে। জঙ্গিবাদ কেউ চায় না। তাই নতুন ভাবনায় সৃজনশীলতা জরুরি। যে ধরনের  ছাত্র-রাজনীতি থেকে প্রতিষ্ঠানের গণতন্ত্রীকরণ হতে পারে, তার রূপরেখা নির্মাণে হাত দিতে হবে। হঠাৎ করে একটি দলের কর্মকাণ্ড শুরু করার আগে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের বহিঃসমাজ সম্পর্কে চেতনা কেমন তার ধারণা নিতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের যৌবন জলতরঙ্গ যেন ভুল রাজনীতির ভ্রান্তপথে দ্রুতগামী হয়ে না যায় তার ভাবনা প্রয়োজন।

ছাত্র-রাজনীতি বলতে আমরা কী বুঝি এবং কী চাই, সেটা পরিষ্কার হলে পথ ও পাথেয়র দ্বন্দ্বের গোলকধাঁধায় ঘুরে মরতে হবে না। শিক্ষাহীনদের হাতে ছাত্র রাজনীতি বন্দি হলে বিবেকবান শিক্ষিতদের জায়গা থাকবে কোথায়? তখনতো দেখা যাবে শিক্ষালয়ের পরিবেশ দূষিত হয়ে এগুলো অন্ধগলির আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে।

syed-Ishtiaque-Reza

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।