ওদের চোখে জীবনের স্বপ্ন নেই কেন?
কতই বা বয়স হবে এদের? পঁচিশের নিচেই তো। কেউ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার ছাত্র। আবার কেউ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের। ‘জান্নাতের লোভ’ দেখিয়ে তাদের মগজ ধোলাই করা হচ্ছে, বানানো হচ্ছে জঙ্গি, বানানো হচ্ছে ভয়ংকর ‘কিলিং মেশিন’। ‘জান্নাতে’ পৌঁছানোর জন্য এই বয়সে এই তরুণদের এত তাড়া কেন?
তরুণ বয়সে কেন তাদের একমাত্র আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মৃত্যু-পরবর্তী ‘জান্নাত’? জীবনের, তারুণ্যের সব আকর্ষণ কি তাদের শেষ হয়ে গেছে? কৈশোর ও তারুণ্য স্বপ্ন দেখার বয়স। এই বয়সে স্বপ্ন থাকবে মহাকাশ জয় করার, নিত্য নতুন আবিষ্কারের, স্বপ্ন থাকবে পিকাসোর চেয়েও ভালো ছবি আঁকার, অলিম্পিকের মেডেল জয়ের। তরুণরা বিভোর থাকবে সৃষ্টির নেশায়। বাংলাদেশের তরুণ হিসেবে তারা স্বপ্ন দেখবে ক্রিকেটে বিশ্বকাপ জয়ের, সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার। তারা হতে চাইবে এভারেস্টজয়ী আরোহী, অস্কারজয়ী চলচ্চিত্রকার। তারা যেতে চাইবে দক্ষিণ মেরুতে, সাগরতলের রহস্যভেদে, আমাজনের অরণ্যে হারানো শহরের খোঁজে, মঙ্গলগ্রহে। তারা চাইবে নতুন গান লিখতে, সেরা সুরে গাইতে, ছবি আঁকতে, গল্প লিখতে, অভিনয় করতে। তারা মন দেবে গবেষণায় নতুন সৃষ্টির প্রেরণায়। এই বয়সেই তারা কেন ভাববে মৃত্যুর কথা, পরকালের কথা? তারা বরং মাটির পৃথিবীতে নিজের দেশকে, নিজের জীবনকে গঠন করার কথা ভাববে। ধর্মচর্চা করুক, কিন্তু জীবনকে বাদ দিয়ে কিংবা জীবনকে বিনষ্ট করে তো ধর্ম নয়। কোনো ধর্মই তো জীবনকে বিনষ্ট করার শিক্ষা দেয় না।
হতাশা থেকেই একজন কিশোর বা তরুণ জীবনের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে, পরিবারের ও নিজের প্রতি দায়িত্বহীন হয়ে পড়ে। তখনই সে মাদকের নেশা কিংবা ‘জান্নাতে’র নেশায় মশগুল হয়ে পড়ে। মনে করে, যে সুখ ও আরাম পেতে হলে জীবনে কঠোর পরিশ্রম ও অনেক সময়ের প্রয়োজন সেই সুখ পাওয়া যাবে অতি সহজে কয়েকজন মানুষকে হত্যা করে কিংবা নিজের গায়ে বোমা বেঁধে ধ্বংস করে। এজন্য লেখাপড়া, শিল্প-সাধনা, খেলাধুলা কোনো কিছুরই প্রয়োজন নেই। যে তরুণের চোখের সামনে উন্নত জীবনের, উচ্চাশার স্বপ্ন নেই, যার চোখে শুধুই অন্ধকার সেই বেছে নেয় জঙ্গি হওয়ার পথ। কারণ ধর্মচর্চা আর জঙ্গিবাদ কোনোভাবেই এক নয়। ধর্মচর্চায় দীর্ঘ সাধনার প্রয়োজন। প্রয়োজন নিজেকে শুদ্ধ করে তোলা। প্রয়োজন আত্মার উন্নতি। সেটা চটজলদি হয় না। সেটার কোনো শর্টকাট পথ নেই। আর বোমা মেরে বেহেশতে যাওয়ার চেষ্টা হলো ঝটপট কিছু একটা করার হঠকারিতা। মানুষকে খুন করে, মানুষের রক্ত ও চোখের জলের উপর দিয়ে বেহেশতে যাওয়ার কোনো উপায় যে নেই সেটা এরা বুঝতে অক্ষম। বেহেশতই হোক কিংবা দুনিয়া-কোথাও মানবতাবিরোধী ও হত্যাকারীর কোনো স্থান নেই।
তারুণ্য অ্যাডভেঞ্চারের বয়স সেটা ঠিক। কিন্তু সেই অ্যাডভেঞ্চার কি করতে হবে মানুষকে হত্যা করে, নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে? ইতিবাচক পথে কি অ্যাডভেঞ্চার হতে পারে না? দলবেঁধে গুলশানের ক্যাফেতে মানুষ মারতে না বেরিয়ে এই তরুণরা কি সাইকেলে বিশ্বভ্রমণের পথে বেরিয়ে অ্যাডভেঞ্চারের ছবি আঁকতে পারতো না? পারতো, যদি শৈশবে বা কৈশোরেই পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাকে সেই স্বপ্ন দেখতে শেখাতো, তার মনে প্রোথিত করতে পারতো জীবন গঠনের বীজ।
গুলশান ট্র্যাজিডিতে দেখা গেছে নারীর প্রতি জঙ্গিদের তীব্র আক্রোশ। নিহত নারীদের তারা যেন অধিকতর আক্রোশের সঙ্গে ক্ষতবিক্ষত করেছে। নারীর প্রতিই বা তাদের এই আক্রোশ কেন? যদি পরিবারের মা, বোন, আত্মীয়, স্কুলে, কলেজে সহপাঠী বান্ধবীদের সঙ্গে তাদের সুস্থ, স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকতো তাহলে তারা নারীকে এইভাবে আক্রমণ ও হত্যা করতে পারতো না। জঙ্গিবাদের সর্বনাশা পথ থেকে এদেশের তারুণ্যকে ফেরানো জন্য সংস্কৃতি ও ক্রীড়া বিষয়ক সংগঠন গড়ে তোলা প্রয়োজন দেশজুড়ে। অতীতে এদেশে খেলাঘর, চাঁদের হাট, মুকুল ফৌজ ইত্যাদি শিশুকিশোর সংগঠন ছিল শক্তিশালী। প্রায় প্রতিটি স্কুলে সক্রিয় ছিল স্কাউট ও গার্লসগাইড সংগঠন। এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আর আগের মতো সক্রিয় নেই। ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম স্কুল এবং মাদ্রাসা প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বয়স্কাউট ও গার্লসগাইড আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন নতুন করে। শিশু সংগঠনগুলো যেন রাজনৈতিক দলবিশেষের অঙ্গসংগঠনে পরিণত না হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
অতীতে প্রতিটি পাড়ায়, মহল্লায় ক্লাব ও লাইব্রেরি ছিল। বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলো মাদকের ও মাস্তানদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ঢাকা ও প্রতিটি জেলা শহরে পৌর পার্কগুলোও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভূমিদস্যুদের কবলে গেছে কিংবা আবর্জনাময় হয়ে মাদকসেবী ও গরু-ছাগলের বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি পাড়ায় যদি পৌরপার্ক থাকে তাহলে কিশোর তরুণ ছেলেমেয়েরা সেখানে খেলতে পারে, সুস্থ জীবন গড়তে পারে। নাট্যদল, সাংস্কৃতিক সংগঠন, বিজ্ঞানক্লাব, বিতর্ক, ফটোগ্রাফি, কম্পিউটার ক্লাব ইত্যাদিতে ছোটবেলা থেকে ছেলেমেয়েদের সুস্থ, স্বাভাবিক মেলামেশা তাদেরকে স্বাভাবিক, সুস্থ মানসিকতার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও পরিবার যখন কোনো শিশুকে সুন্দর জীবন গঠনের স্বপ্ন দেখতে শেখায়, যখন তরুণকে অনুপ্রাণিত করে ইতিবাচক পথে বিশ্বজয়ে তখন আর সে অতিদ্রুত ‘জান্নাত’ পাওয়ার লোভে মানুষকে মারতে ও নিজে মরতে উৎসাহিত হয় না। বরং জীবনকেই সুন্দর করে তুলতে চায়, বাঁচতে চায় সুস্থভাবে, বলতে চায় ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’।
লেখক : কবি, সাংবাদিক
এইচআর/পিআর