গভীর বেদনায় মোড়ানো ঈদ
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ। দুটি ঈদ। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। ঈদুল আযহা উদযাপনের ধরনটাই আলাদা। ঈদুল আযহা পালনের প্রধান অনুষঙ্গ পশু কোরবানি। তাই সাধারণভাবে মুসলমানদের মূল উদযাপন ঈদুল ফিতরে। ৩০ দিনের সিয়াম সাধনা শেষে ঈদ আসে উৎসবের বারতা নিয়ে। টিভিতে যখন বেজে ওঠে কাজী নজরুলের সেই ঐতিহাসিক গান ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ...’ আমরা বুঝে যাই ঈদ চলে এসেছে।
এখন জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি বৈঠক করেন, বৈঠক শেষে ঘোষণা দেন ঈদ হবে কি হবে না। মধ্যরাতেও ঈদের সরকারি ঘোসণা এসেছে। এখন আর নিজের চোখে ঈদের চাঁদ কেউ দেখে কি না জানি না। তবে আমাদের ছেলেবেলায় ঘোষণা-টোষণা যাই হোক, নিজের চোখে চাঁদ দেখা নিয়ে দারুণ প্রতিযোগিতা হতো। ২৯ রোজা হলেই ইফতারের পর পর আমরা দল বেধে খোলা মাঠে চলে যেতাম বা কাছ থেকে চাঁদ দেখার লোভে মসজিদের ছাদে উঠে যেতাম।
তারপর চলতো ঐ, ঐ দেখা যায় চাঁদ। এক চিলতে চাঁদ, দেখাও দেখা যেতো অল্প সময়ের জন্য। তার জন্য কত হুড়োহুড়ি। যারা দেখতে পেত না তারা খুব মন খারাপ করতো। কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য। চাঁদ দেখা গেলে সব কষ্ট ভুলে সবাই হইচই করে মেতে উঠতাম ঈদ উৎসবে। ঈদুল আযহা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তাই শেষ মুহূর্তের উত্তেজনাও নেই।
ছেলেবেলায় আমরা ঈদুল ফিতরের আগে নতুন পোশাক-জুতা পেতাম। যেহেতু ঈদুল আযহায় কুরবানির বাড়তি খরচ থাকতো, তাই সেই ঈদে আর পোশাক-জুতা পাওয়া যেতো না। ঈদুল ফিতরের আগে নতুন পোশাক লুকিয়ে রাখতাম, যাতে ভাই-বোন বা বন্ধুদের কেউ না দেখতে পারে। জুতার প্যাকেট নিয়ে ঘুমাতে যেতাম। কেউ দেখে ফেললেই যেন আনন্দ মাটি। কান্নাকাটি করে বাড়ি মাথায় তুলতাম।
ঈদের আনন্দে আগের রাতে ঘুম হতো না। কিন্তু সকাল সকাল উঠে যেতাম। সকালেই আব্বার হাত ধরে আমরা মসজিদের ঘাটে গোসল করতে যেতাম। গোসলের আগে আমাদের একটা কাজ ছিল মসজিদের পাশে দাদার কবরে পানি দেয়া। গোসল করে বাড়ি ফিরেই নতুন পোশাক আর আতর লাগিয়ে ছুটে যেতাম ইদগাহে। ঈদের নামাজ পড়ে কোলাকুলি করে বাড়ি ফিরতাম। কিছুটা সেলামির লোভে, কিছুটা ঐতিহ্যের কারণে বড়দের সালাম করতাম। মায়ের হাতের রান্না করা সেমাই দিয়ে শুরু হতো ঈদের দিনের খাওয়া। তারপর আমরা মুক্ত, স্বাধীন। সারাদিন টই টই করে বেড়ানো।
সেলামি হিসেবে পাওয়া এক-দুই টাকা দিয়ে আইসক্রিম, চকলেট, টফি, আচার- দিনভর অখাদ্যে ব্যস্ত থাকতাম। বাড়িতে আর ফেরাই হতো না, খাওয়া তো দূরের কথা। খিদা পেলে কোনো না কোনো বন্ধুর বাসায় খেয়ে নিতাম। এভাবেই চলতো, চলতেই থাকতো। ঈদ শেষ হতো বিটিভিতে বাংলা সিনেমা দেখে। আমাদের বাড়িতে তো দূরের কথা, আমাদের গ্রামেই কোনো টিভি ছিল না। বাজারে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে যেতাম টিভি দেখতে। বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেতো ঈদের দিনটি।
এখন শহুরে ঈদ অনেক বেশি ঝলমলে, অনেক চাকচিক্য তাতে। অন্তত ১৫ দিন আগে থেকেই চলে কেনাকাটা। অনেকে ঈদের কেনাকাটা করতে ব্যাংকক, অন্তত কলকাতা চলে যান। রোজার শেষ ১০ দিন ঢাকার কোনো শপিং মলে পা ফেলার জায়গা থাকে না। শপিং মল খোলা থাকে গভীর রাত পর্যন্ত। কিন্তু সবই কেমন যান্ত্রিক লাগে আমার কাছে। হতে পারে, বয়স এবং পেশার কারণে ঈদ এখন আর আমার কাছে অত আনন্দের উপলক্ষ নয়। টিভিতে কাজ করার কারণে তো ঈদের দিনেও ছুটি মেলে না। তবুও ছেলেবেলার সেই ঈদ বড় বেশি মিস করি।
তবে এখনও মুসলমানদের কাছে বছরের সবচেয়ে বড় আনন্দের উপলক্ষ ঈদুল ফিতর। তবে এবারের ঈদুল ফিতর এসেছে গভীর বেদনার চাদরে মুড়ে। এমন বিষাদময় ঈদ বাংলাদেশে আসেনি কখনো। মাত্র এক সপ্তাহ আগে গুলশানের হলি আর্টিজানে রক্তের যে হোলি খেলা হলো তার রেশ রয়ে গেছে দেশজুড়ে। দুদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হলেও শোকের ধকল কাটেনি এখনও। এখনও টিভির পর্দায়, টক শোতে, পত্রিকার পাতায়, চায়ের কাপে, ঘরে ঘরে গুলশান ট্র্যাজেডি নিয়ে আলোচনা, বিশ্লেষণ।
কারা গুলশানের ঘটনা ঘটিয়েছে, সেটা এখন সবাই জানেন। তারা আইএস না আল কায়েদা না জেএমবি- তা নিয়ে নানা সংশয়। তবে একটি ব্যাপার নিশ্চিত, যারাই করুক, তারা ইসলামের নামে করেছে। জুমাতুল বিদার রাতে, লাইলাতুল কদরের আগের রাতে তারা ইসলামের নামে নির্মমতার যে চরম উদাহরণ সৃষ্টি করলো, তাতে ইসলামের ভাবমূর্তি কি উজ্জ্বল হলো।
হামলার পরের সকালে অপারেশন থান্ডারবোল্টের আগে জিম্মিদের ছেড়ে দেয়ার সময় নাকি জঙ্গিরা বলেছে, তারা কিছুক্ষণের মধ্যে বেহেশতে চলে যাচ্ছে। কিন্তু যাওয়ার আগে তারা গোটা দেশকে কোন নরকে রেখে গেল? সন্ত্রাসের সমার্থক বানিয়ে ফেলে বিশ্বজুড়ে যে ইসলামকে, মুসলমানদের হেয় করা হচ্ছে, তাতে ইসলামের কী লাভ হচ্ছে? যে ২২ জন মানুষকে জঙ্গিরা মেরেছে, তাদের সাথে জঙ্গিদের ব্যক্তিগত শত্রুতা তো দূরের কথা, হয়তো পরিচয়ই ছিল না। মানুষ মারলে বেহেশত মেলে এ কথা ইসলামের কোথায় লেখা আছে?
এনএফ/পিআর