সব ফকফকা, সব কিলিয়ার


প্রকাশিত: ০৪:১৪ এএম, ০২ জুলাই ২০১৬

‘খবর এখন যেমন দাদখানি বেল মসুরের তেল সূত্রে জানা যায় যে, অনিন্দ্য সুন্দরী মুসার স্ত্রী হলো জঙ্গী বাবুল। সোর্স মিতুর সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। আড়াই হাজার টাকা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছিল এসপি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। মোটরসাইকেলে হেঁটে গিয়ে তাকে মোবাইল করে ওয়াসিম, শাবানা, রাজ্জাক ও আনোয়ার হোসেন। কেউ খুন হয়েছে কিনা এখনও জানা যায়নি, তবে কাউকে চাকরি ছাড়তে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক গীতিআরা নাসরিন আপার ফেসবুক স্ট্যাটাস এটি। পড়ে হাসতে হাসতে আমার বিষম লেগে গেল। শুরুতে হাসলেও পরে আবার পড়ে দেখলাম, এটা তো হাসির স্যাটাস নয়, এটাই তো এখন বাংলাদেশের চিত্র, সবকিছু তালক্রিকেট পাকানো। মিতু হত্যা নিয়ে আমার মাথায় জটিল প্যাচ লেগেছিল- কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যা, কোনটা সাংবাদিকতা, কোনটা অপসাংবাদিকতা, কোনটা এথিক্স, কোনটা হলুদ, কোনটা লাল, কে হিরো, কে ভিলেন? গীতি আপার স্ট্যাটাস পড়ার পর আমার মাথা খুলে গেল, এখন সব ফকফকা, সব কিলিয়ার। যায় যাবে যাক প্রাণ, হীরকের রাজা ভগবান।

গত ৫ জুন সকালে চট্টগ্রামে প্রকাশ্য রাজপথে ছেলের সামনে খুন হন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। তদন্তের আগেই সবাই মিলে দায় চাপালো অদৃশ্য জঙ্গিদের ঘাড়ে। এটা তো জানা কথাই, পানি যখন ঘোলা হবে, তখন অনেকেই মাছ শিকারে নেমে পড়বে। জঙ্গিরা পানি ঘোলা করেই রেখেছে। এখন কাজ হলো সাবধানে সেখানে মাছ শিকারে নেমে পড়া। তাই হয়েছে। একজন পুলিশ সুপারের স্ত্রী খুন হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশ খুনিদের ধরতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। বাংলাদেশের পুলিশের দক্ষতার ওপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। যদিও বেশিরভাগ সময় তাদের দক্ষতা ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশের জালে বাধা থাকে। তবুও ফাঁক পেলেই তারা তাদের দক্ষতার প্রমাণ দেয়। কয়েকদিন আগে মধ্যরাতে ইস্কাটনে জনকণ্ঠ অফিসের সামনে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তের গুলিতে দুই নিন্মবিত্ত মানুষ মারা যায়। পত্রিকায় ভেতরের পাতার এই সংবাদ নিমেষেই হারিয়ে যায়। মিডিয়ার কোনো চাপ ছাড়াই পুলিশ ক্লু লেস এই খুনের রহস্য বের করে ফেলে। কেঁচো খুড়তে বেরিয়ে আসে অজগর। এই ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে আছেন এমপি পুত্র রনি। মিতু হত্যার ঘটনায়ও তেমন কিছু ঘটতে পারতো। তদন্তে এখন পর্যন্ত যা হয়েছে, তাতে অ্যানাকোন্ডার লেজ দেখা যাচ্ছে।

মিতু হত্যার তদন্ত চলছিল স্বাভাবিকভাবেই। সন্দেহভাজনরা ধরাও পড়ছিলেন। কিন্তু পুরো ঘটনা নাটকীয় মোড় নেয় গত ২৪ জুন মধ্যরাতে মামলার বাদী বাবুল আক্তারকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায়। ১৫ মিনিটের জন্য নিয়ে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয় ১৫ ঘণ্টা পর। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়া এ বিষয়ে এখনও কেউ মুখ খোলেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, পাওয়া তথ্য যাচাই করতে বাদী হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে তাকে নেয়া হয়েছিল। এ ঘটনায় তার জড়িত থাকার কোনো তথ্য এখনও নেই। কিন্তু একটি মামলার বাদী, যিনি আবার পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মরত কর্মকর্তা, তাকে মধ্যরাতে নিয়ে ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করতে হলো কেন? এই সময়ে তিনি বাসার সাথে ফোনেও যোগাযোগ করতে পারেননি। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি কেউ বিশ্বাস করেনি। ছড়িয়েছে গুজবের নানা ডালপালা।

বিভ্রান্ত হওয়ার ভয়ে আমি মিতু হত্যা ইস্যুতে বেশি পত্রিকা পড়ি না। তবুও নানা সূত্রে, ফেসবুকে, অনলাইনে, অফলাইনে, আড্ডায়, রিপোর্টারদের সূত্রে নানামুখী তথ্য কানে এসেছে। সবচেয়ে প্রচলিত গল্পটা এমন, বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতুর সাথে চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ীর পরকীয়া প্রেম ছিল। প্রতিশোধ নিতে বাবুল আক্তার তার সোর্স দিয়ে স্ত্রীকে হত্যা করিয়েছেন। তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ এই তথ্য জেনে গেছে। এ কারণেই বাবুল আক্তারকে ডেকে নিয়ে ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এই সময় ডিআইজি পদমর্যাদার তিনজন কর্মকর্তা বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা জানিয়ে দেন, পুলিশ সবকিছু জেনে গেছে। এখন বাবুল আক্তারের সামনে দুটি অপশন- বাদী থেকে আসামিতে বদলে গিয়ে কারাগারে যাওয়া অথবা চাকরি ছেড়ে আড়ালে চলে যাওয়া। বাবুল আক্তার নাকি দ্বিতীয় অপশনটাই বেছে নিয়েছেন। সেখানে নাকি বাবুল আক্তারের কাছ থেকে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে রাখা হয়েছে। তবে এ নিয়েও রয়েছে নানা মত।

জিজ্ঞাসাবাদ থেকে ফেরার পর থেকে বাবুল আক্তার নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। যেহেতু পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলা হয়নি। তাই সাংবাদিকরা মনের মাধুরি মিশিয়ে গল্প লিখতে বাধ্য হচ্ছেন। সাংবাদিকরা খালি দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর চেষ্টা করছেন। মিতু হত্যায় সরাসরি অংশ নিয়েছেন, এমন দুজন ওয়াসিম ও আনোয়ার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সত্য হোক, মিথ্যা হোক; তাদের জবানবন্দিতে পুরো ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। তারা কেউ মিতুকে চিনতেন না। মুছা শিকদার নামে একজন তাদের ভাড়া করেছে। তারা ঘটনার আগের রাতে মুছা শিকদারের বাসায় ছিল। সেখান থেকেই সকালে তারা অপারেশনে যায়। খুনিরা বাসায় ফিরে টিভি দেখে জেনেছে যে, তারা এক পুলিশ অফিসারের স্ত্রীকে খুন করে এসেছে। মুছা শিকদার নাকি বাবুল আক্তারের সোর্স ছিলেন। এখন মুছা শিকদার কার নির্দেশে মিতুকে হত্যা করেছে, সেটা জানলেই রহস্যের সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু মুছা শিকদার হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। তবে তার পরিবারের সদস্যরা দাবি করছেন, মুছাকে ১২ তারিখেই পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। তারপর থেকে মুছার আর কোনো খোঁজ নেই। খোঁজ নেই তার পরিবারেরও। ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের সময় নাকি বাবুল আক্তারকে মুছার মুখোমুখি করা হয়েছিল। তাহলে মুছা গেল কোথায়? আশঙ্কা করা হচ্ছে, মুছাকে আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না। তাই আর কখনোই জানা হবে না, মিতু হত্যাকাণ্ডের আসল নির্দেশদাতার নাম।

পত্রিকার পাতায় পাতায় ছড়ানো এই গল্পের কতটা সত্যি, কতটা মিথ্যা; সেটা পুলিশ ভালো বলতে পারবে। কিন্তু বলা হচ্ছে, পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি বজায় রাখতে মুছা শিকদার হারিয়ে যাবেন চিরতরে, যাতে বাবুল আক্তারের নাম সামনে না আসে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, পুলিশের ভাবমূর্তি কীভাবে রক্ষা হয়, কীভাবে ধসে পড়ে। বাবুল আক্তার যদি সত্যি সত্যি অপরাধী হন, তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আইনের আওতায় আনলেই তো পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। একজন ব্যক্তির অপরাধে নিশ্চয়ই ধসে যাবে না গোটা বাহিনীর ভাবমূর্তি। বরং সত্যটা আড়াল করার চেষ্টার কারণে যে নানাবিধ গুজব আর গল্প তৈরি হচ্ছে, তা কি বাহিনীর ভাবমূর্তি গড়ছে নাকি আরো ধসিয়ে দিচ্ছে। স্ত্রী খুনের পর থেকে বাবুল আক্তার অফিসে যাচ্ছেন না। কেন? যদি তিনি দোষী না হতেন, এতদিনে তো তার অফিসে যোগ দেয়ার কথা ছিল। তার মানে কোনো না কোনো সমস্যা আছে। সে রহস্য উন্মোচনের দায়িত্ব পুলিশেরই। নির্দোষ হলে বাবুল আক্তার শিগগিরই কাজে যোগ দেবেন। আর দোষী হলে কারাগারে যাবেন। মাঝামাঝি কোনো রাস্তা রেই। রাষ্ট্রপতির পদক পাওয়া একজন চৌকস পুলিশ অফিসার অসময়ে চাকরি ছাড়বেন কেন? আর অপরাধী হলে তো চাকরি ছাড়াটা কোনো শাস্তি নয়। যত শিগগির সম্ভব, বিষয়টি পরিষ্কর করতে হবে। মুছা শিকদারকে খুঁজে বের করতে হবে। নইলে আরো নানা গল্প তৈরি হবে, যা পুলিশের ভাবমূর্তির আরো ক্ষতি করবে।

বাবুল আক্তারের ১৫ ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদের দিন বাংলানিউজ২৪ডটকম ও বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ কয়েকটি গণমাধ্যম মিতুর পরকীয়ার গল্পটি লিখেছিল বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে। তারপরই ফেসবুকে আর টক শোতে ঝড় ওঠে। সবাই সাংবাদিকতার শিক্ষক হয়ে ওঠেন। সবাই মিলে সাংবাদিকদের এথিক্স, বস্তুনিষ্ঠতা শেখাতে শুরু করেন। আর ঢালাওভাবে সাংবাদিকদের গালিগালাজ তো ছিলই। তুমুল সমালোচনার মুখে বাংলানিউজ২৪ডটকম নিউজটি প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। এখন ঘটনা যদি তাই হয়, তাহলে যারা আমাদের গালি দিয়েছিলেন, তারা কি গালি ফিরিয়ে নেবেন। ঘটনা কিন্তু আস্তে আস্তে সেদিকে যাচ্ছে। পুলিশ সত্যটা না জানানো পর্যন্ত ঘুড়ি ওড়ানো সাংবাদিকতা চলতেই থাকবে। তবে একটা কথা বলতে পারি, সাংবাদিকরা লেগে না থাকলে কিন্তু অপরাধীরা পার পেয়ে যেতে পারে। হয়তো খুনের নির্দেশের শাস্তি চাকরি ছাড়াতেই থেমে যেতে পারে। তাই গণমাধ্যমকে সজাগ থাকতেই হবে। তবে মরে যাওয়া কারো চরিত্রে কালিমা লেপন করাটা রুচিকর সাংবাদিকতা নয়। এটা মাথায় রেখে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে কাজ করে যেতে হবে।

Provash-amin

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।