ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস : প্রগতি বনাম প্রতিক্রিয়া


প্রকাশিত: ০২:২৮ এএম, ০১ জুলাই ২০১৬

১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। প্রতি বছর ১লা জুলাই এলেই দেশের মিডিয়াতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আলোচনা হয়, প্রবন্ধ-নিবন্ধও ছাপা হয়। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এ দিন প্রায় সব মিডিয়াতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়ের সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতির দিকটি প্রাধান্য পায়। যে কারণে, আলোচক বা লেখকরা স্পষ্ট করে না-বললেও পরিষ্কার হয়ে যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম আসলে একটি প্রতিক্রিয়ার ফসল। আর আলোচক বা লেখকবৃন্দ এরচেয়ে বেশি তথ্য না দেবার কারণে প্রতি বছরের ১লা জুলাইয়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত অনুষ্ঠান, আলোচনা বা প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনায় পরোক্ষভাবে একটি বিদ্বেষভাব ফুটে ওঠে, যা মূলত সম্প্রীতির পক্ষে সহায়ক নয়। অথচ, ব্যাপারটি এভাবে উঠে আসা উচিত নয়, অন্তত স্বাধীন মুক্ত বাংলাদেশের উদার পরিমণ্ডলেতো নয়ই।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ‘জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো’- এই প্রবাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সার্থক করেছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যারা আলোচনা করেন তারা এই প্রবাদের মর্মার্থ ভুলে যান। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের পর ১৯১২ সালের ৩১শে জানুয়ারি ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা সফরে এলে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল তাঁর কাছে তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের উচ্চশিক্ষার জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। সে-সূত্রেই ১৯১২ সালের ২৭শে মে রবার্ট নাথান-কমিশন গঠিত হয় এবং তাঁরা সুপারিশ করেন অক্সফোর্ডের আদলে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার।

১৯২০ সালের ১৮ই মার্চ ‘দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি এ্যাক্ট’ পাস হলে ১৯২১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা আরম্ভ করে আজকের ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কারণে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক, যুক্তিবাদ ও স্বাধীনতার চেতনার প্রসার ঘটে এবং মানুষের মনোজগতে এক বিরাট পরিবর্তন দেখা দেয়। পূর্ববঙ্গে যেহেতু মুসলিম সংখ্যা-গরিষ্ঠতা, সেহেতু এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কারণে মুখ্যত মুসলিমরাই উপকৃত হয়। তবে, শিক্ষাদান ও গবেষণা-প্রধান করে আবাসিক সুবিধাসম্বলিত অর্থাৎ অক্সফোর্ডের আদলে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি পেতে থাকে।

এ তথ্যটুকু প্রায় সব লেখক একইভাবে উল্লেখ করেন। কিন্তু এর পরই তাঁরা লেখেন এমন কথা যা বিস্তৃত ব্যাখ্যা না দেয়ায় সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রো-উপাচার্য লিখেছেন: ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও হিন্দু মালিকানাধীন পত্রপত্রিকার আশংকা ছিল এটি ধর্মীয় শিক্ষাসর্বস্ব পূর্ববাংলার মুসলমানদের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। তাই এটিকে মক্কী বিশ্ববিদ্যালয় বলে কটাক্ষ পর্যন্ত করেছেন।’ (সূত্র: গৌরবের ৮৯ বছর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস ২০১০ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা; প্রবন্ধ-শিরোনাম: ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে স্বপ্নযাত্রা’) সাবেক সচিব ও এনবিআর-এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ লেখেন: ‘এ ঘোষণার [ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের] তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার নামে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক আইনজীবী, হিন্দু জমিদার এবং স্টেটসম্যান ও বেঙ্গলি পত্রিকা। ১২ই ফেব্রুয়ারি প্রখ্যাত আইনজীবী ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ভাইসরয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আপত্তি উত্থাপন করেন। সরকার আগের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।’ (দৈনিক সংবাদ, ২রা জুলাই, ২০১২) লক্ষ করার বিষয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-উপাচার্য হিসেবে লেখক লিখেছেন ‘হিন্দু মালিকানাধীন পত্রপত্রিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। আসলে তখন স্টেটসম্যান ও বেঙ্গলি পত্রিকায় এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা হয়েছিল, যা ড. মজিদও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু স্টেটসম্যান ও বেঙ্গলি পত্রিকার বিরোধিতাকে ঢালাওভাবে ‘হিন্দু মালিকানাধীন পত্রপত্রিকা’র বিরোধিতা বলা যাবে কি?

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল দৈনিক সংগ্রাম, মিল্লাতসহ কয়েকটি পত্রিকা। সে পত্রিকাগুলোর মালিক ছিল ধর্মে মুসলমান। তাহলেই কি বলা সঙ্গত হবে যে, ‘মুসলিম মালিকানাধীন’ সংবাদপত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল? সঙ্গত হবে না। কারণ, তখন প্রধান প্রধান পত্রপত্রিকার মালিকানা মুখ্যত মুসলিমদের হাতে ছিল আর এ থেকে একটি-দুটি পত্রিকা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ মূলত আদর্শিক ব্যাপার, ধর্মের ব্যাপার নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালেও প্রধান প্রধান পত্রিকার মালিকানা হিন্দুদের হাতে ছিল। সেখানে দুটি পত্রিকার বিরোধিতাকে ‘হিন্দু মালিকানাধীন পত্রপত্রিকা’র বিরোধিতা বলে ড. হারুন যে উল্লেখ করেছেন তা ঠিক নয় এবং তা এক পেশে নিশ্চয়। প্রয়োজন ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাকারীদের আদর্শগত পরিচয়টি মুখ্যভাবে চিহ্নিত করা, ধর্মগত দিকটি মুখ্য করা নয়।

আবদুল মজিদের লেখাতে ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলের কথা আছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এককালীন উপাচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদারের ভাষ্য জানা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণায় বাংলার যে হিন্দুরা এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন ‘তাঁদের প্রধান আপত্তির কারণ ছিল যে এর ফলে রাজনৈতিক ভাগের পরিবর্তে বাংলা দেশকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে দুই ভাগ করা হবে। গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রাসবিহারী ঘোষ প্রভৃতি সে যুগের নেতাগণ ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধিতা করলেন বড় বড় সভায় এবং খবরের কাগজে কিছু দিন যাবৎ খুব বিরুদ্ধ সমালোচনা হল। বলা বাহুল্য, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ও এর বিরুদ্ধে ছিলেন; কারণ, পূর্ববাংলার জন্য একটি আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় হলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব ক্ষতি হবে এবং প্রভাব ও প্রতিপত্তি খুব কমে যাবে। কিন্তু কিছু দিন পরে তিনি প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করা বন্ধ করলেন।’ (আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭৪, কলকাতা, পৃ. ২৬) আর. সি. মজুমদারের লেখার একটি বাক্য আমি নিম্নরেখ করে দিয়েছি এ কারণে যে, ঐ একটি বাক্য বিশ্লেষণ করলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষ-বিপক্ষের সমস্ত ধারণা স্পষ্ট হয়। কিন্তু ঐ কথাটি এখন আর কেউ লেখেন না, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণতো করেন-ই না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনাতে প্রো-উপাচার্য লেখেন না, প্রগতিশীল পত্রিকা হিসেবে পরিচিত দৈনিক সংবাদ-এ এনবিআর-এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদও লেখেন না। ফলে জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম বা প্রতিক্রিয়াশীলদের মুখপত্র দৈনিক ইনকিলাব লিখবে কেন? এসব কথায় মনে হয়, তৎকালে দেশের সব হিন্দু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। আসলে, ইংরেজরা বাঙালি জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মেজাজে স্পষ্ট দুটো ভাগ করতে চেয়েছিলেন। ভৌগোলিকভাবেও তেমনটাই প্রত্যাশা ছিল তাদের। কিছু হিন্দু নেতা এর বিরোধিতা করতে যেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে অবস্থান নেন। স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের একজন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য (১৮৯০-১৮৯৩) এবং পরে জাতীয় শিক্ষা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনিও মনে করতেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পেছনে লুকিয়ে আছে বাংলা দেশকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে দুই ভাগ করার ইংরেজ-পরিকল্পনা। তাই এর বিরোধিতা তিনি করেছিলেন। এই বিরোধিতা তিনি ‘হিন্দু’ হিসেবে করেন নি, করেছিলেন রাজনৈতিক আদর্শের কারণে।
 
রমেশচন্দ্র মজুমদারের উদ্ধৃত বক্তব্যে আছে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করেছিলেন এবং পরে এই বিরোধিতা থেকে তিনি সরে আসেন। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের টানা পাঁচবার নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্য। এই বিশ্ববিদ্যালয় জাতির উচ্চাসনে বসানোর জন্য তিনি যা করেছেন তা আজ শুধুই ইতিহাস। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরে তাঁর নামে একটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ভবনের নামকরণ হয়েছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার যে লিখেছেন, ‘কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ও এর বিরুদ্ধে ছিলেন; কারণ, পূর্ববাংলার জন্য একটি আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় হলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব ক্ষতি হবে এবং প্রভাব ও প্রতিপত্তি খুব কমে যাবে।’- কথাটি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বিবেচনায় একেবারেই ঠিক। আমি একে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি একনিষ্ঠ একজন উপাচার্যের ‘বিরোধিতা-কৌশল’ বলতে চাই। ‘বিরোধিতা-কৌশল’ কেন বলছি? কারণ, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁর এ ‘বিরোধিতা-কৌশল’ প্রত্যাহার করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চারটি স্থায়ী অধ্যাপক পদের বিনিময়ে। আজ চারটি স্থায়ী অধ্যাপক পদ খুব সামান্য বিষয় হতে পারে, সেদিন তা ছিল না। রমেশচন্দ্র মজুমদার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ভাষ্য দিয়ে লিখেছেন, আশুতোষ বড়লাট হার্ডিঞ্জকে বলেছেন: ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি চারটি অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করে গভর্নমেন্ট বরাবর তার খরচ বহন করেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে কোন আপত্তি কর্ব না।’ (আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭৪, কলকাতা, পৃ. ২৭)

বলা বাহুল্য, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় অতি দ্রুত চারটি অধ্যাপক পদ পেয়েছিলেন। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের এই বিরোধিতাকে কি হিন্দুর বা সাম্প্রদায়িক বিরোধিতা বলা যাবে? যাবে না। কারণ, দেখা যাচ্ছে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ চারটি পাওয়ামাত্র তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সাহায্য করেন। নবগঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ার দায়িত্ব নেবার জন্য রমেশচন্দ্র মজুমদারকে তিনিই কলকাতা থেকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, ইতিহাস বিভাগ, কলা অনুষদ, জগন্নাথ হল সর্বোপরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আর. সি. মজুমদার নামের এই মানুষটির অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। চিরস্মরণীয় অবদান যিনি রেখেছেন, সেই আর. সি. মজুমদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে লিখেছেন: ‘আশুতোষের সুপারিশেই যে আমি চাকরী পেয়েছি, তাতে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না।’ (ঐ) তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাকারী আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কি নিজে ‘হিন্দু’ বলে এই বিরোধিতা করেছিলেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর, অর্থাৎ ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তিনটি অনুষদভুক্ত যে তেরোটি বিভাগ ছিল, তার প্রায় সবগুলোতেইতো হিন্দু বিভাগীয় প্রধান ও হিন্দু অধ্যাপকগণ নিরলস কাজ করে বিভাগকে গড়ে তুলেছেন। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো অনেকেই কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে অধ্যাপনা করেছেন। এ-প্রসঙ্গে প্রখ্যাত কবি মোহিতলাল মজুমদার, রবীন্দ্রস্নেহধন্য চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখ করা যায়।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষকতালিকা দেখলেই বোঝা যাবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালে অমুসলিম বা হিন্দু শিক্ষকগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনাকালীন ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক প্রফুল্লকুমার গুহ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মুসলমান শিক্ষক ও ছাত্রদের জন্য যে বিশেষ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা হলো তা হিন্দু শিক্ষক বা হিন্দু ছাত্রদের মনে কোনো ঈর্ষার উদ্রেক করলো না। হিন্দু শিক্ষকেরা একটি missionary spirit-এ তাঁদের ব্রত পালন করলেন। মুসলমানদিগের মধ্যে উচ্চশিক্ষা প্রসারিত হয় নাই- মুসলমান ছাত্রদিগকে শিক্ষাদান করে তাদের দ্বারা মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি middle class সৃষ্টি করার সহায়তা হিন্দু শিক্ষক ও প্রশাসকগণ একটি পুণ্যকার্য হিসাবে গ্রহণ করলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত মুসলমান ছাত্রগণই বর্তমান Muslim Middle Class সৃষ্টির ভিত্তিস্থাপন করলো। এদের পরবর্তীগণই শেখ মুজিবুর রহমানের পার্শ্বচর হয়ে স্বাধীন বাংলা স্থাপন করলো।’ (ঐ, পৃ. ৭)

অধ্যাপক প্রফুল্ল গুহের এই বিশ্লেষণ যথার্থ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে মুষ্টিমেয় লোক প্রতিষ্ঠানটির বিরোধিতা করেছিলেন, এটা সত্য এবং তার নানাবিধ কারণ ছিল, এটাও মিথ্যে নয়। বিরোধিতাকারীদের নাম এবং কারণসমূহ উল্লেখ বা স্মরণ আজ করা হয় না। বরং ‘হিন্দু’রা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন- এ রকম একটি সাধারণ ধারণা পহেলা জুলাই এলেই পরোক্ষভাবে বা প্রকারান্তরে জনগণকে মনে করিয়ে দেয়া হয়। এই ধারণা যে সত্যের অপলাপ মাত্র, তা লেখাই বাহুল্য। যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলেন, তাদের মধ্যে মুখ্যত হিন্দুরাই ছিলেন। কিন্তু তার মানে এই নয়, সব হিন্দু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল! যদি তাই হয়, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার মহান কর্মযজ্ঞটি সম্পন্ন করার জন্য কেন তাঁরা এতো উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে আসবেন?
 
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে এই প্রতিষ্ঠানের একটি পর্বান্তর সূচিত হয়। ভারতভাগ ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নতুন ভূমিকা নিয়ে অবির্ভূত হয়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের আগ-পর্যন্ত অক্সফোর্ডের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক চরিত্র সার্বিক অর্থেই অক্ষুণ্ণ থাকে। তাছাড়া এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। সাংস্কৃতিক বোধের ক্ষেত্রে তখন উদ্দীপক কিছু কর্ম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দটা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই একটি বছরেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন এবং এই আগমনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে সাংস্কৃতিক উত্তালতা তৈরি হয়; কাজী নজরুল ইসলামও প্রথম বারের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন এ বছর এবং তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা দেন যা তরুণ মুসলিমদের (ছাত্র) খুব আকৃষ্ট করে; আর ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’ বা বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন নামে মুসলিমদের একটি উদার সংগঠনের জন্ম হয় এ বছরই, যা পরবর্তীকালে মুসলিমসমাজের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। কিন্তু পাকিস্তানের সূচনাতেই রাজনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে এই বিশ্ববিদ্যালয়। যেহেতু ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারতের সৃষ্টি হয়, সেহেতু এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে ভারতে চলে যান অনেক হিন্দু বিদ্যার্থী ও শিক্ষক। এ সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে যাওয়া বিদ্যার্থী ও শিক্ষকদের পরিসংখ্যান নিলেই বোঝা যাবে, কতোটা আন্তরিকতা নিয়ে হিন্দু-মুসলিম মিলিতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলছিলেন। শুরুতে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি থাকলে হিন্দু-মুসলিমের সম্মিলিত উদ্যোগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর অভিযাত্রা আরম্ভ করে। কিন্তু দেশভাগ তার ছেদ ঘটায়।

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ভাষা-সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক কর্মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে পড়ার ইতিহাস পাওয়া যায় এবং বলা চলে, প্রত্যক্ষভাবে সম্প্রদায়নিরপেক্ষ কর্মে তারা আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য শ্রীধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানালে তাঁর দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম মন্তব্য করেছেন: ‘ফলে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় সে দিনই।’ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ১৯৯২, ঢাকা; পৃ. ৩৬) এই আন্দোলন বেগবান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ। গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবি প্রত্যাখ্যাত হলে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই মার্চ তারা এর প্রতিবাদে মিছিল, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করে।

১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা মার্চ থেকে নানা দাবিতে ধর্মঘটে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিম্ন কর্মচারীরা’ (তখন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিম্নকর্মচারী বলা হতো)। ২৬শে এপ্রিল এই ধর্মঘট প্রত্যাহারের আগ-পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় দুমাসের এ আন্দোলন মূলত পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। উল্লেখ্য, এই আন্দোলনে সক্রিয় সহযোগিতা করার দায়ে কয়েকজন ছাত্রছাত্রীকে শাস্তি প্রদান করা হয়। এর মধ্যে ৪ বছরের জন্য বহিষ্কার, হল থেকে বহিষ্কার, পনের টাকা জরিমানা, দশ টাকা জরিমানা এবং সদাচরণের মুচলেকা প্রদান শাস্তি হিসেবে প্রদান করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে (পরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) পনের টাকা জরিমানা ও সদাচরণের মুচলেকা প্রদানের শাস্তি দিলে তিনি এর কোনোটাই প্রদান করেন নি। তাই তাঁকে কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে এই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়।

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের সংঘটিত হয় জগৎ-চমকানো রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন এবং সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষকদের অংশগ্রহণের তথ্য সবারই জানা। এই আন্দোলনে নিহতদের মধ্যে আবুল বরকত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে গভর্নর ও চ্যান্সেলর মোনায়েম খানের হাত থেকে শিক্ষাসনদ গ্রহণে অস্বীকৃতি ও তার আগমন প্রতিহত করার জন্য ছাত্রসমাজের প্রত্যয়ও বিশেষভাবে স্মরণার্হ। এর পর থেকে পাকিস্তান আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঔপনিবেশিক পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে। নানা কালা-কানুনে বাংলার রেনেসাঁর এই বিদ্যাপীঠটিকে বেঁধে ফেলা হয়। রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার হয়ে একটি অগ্রসরমান আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব আঙিনা থেকে ক্রমেই পিছিয়ে পড়তে থাকে। তারপরও ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামসহ বাঙালির প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের কেন্দ্রে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, ২৫শে মার্চ জগন্নাথ হলসহ বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানিদের আক্রমণের শিকার হওয়া এ আন্দোলন ও আত্মত্যাগ সব কিছুই স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় সংঘটিত হয়েছিল। আর এর নেতৃত্বে, কখনো পেছনে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালেও বাঙালির বিভিন্ন সমস্যা ও সংকট মোকাবিলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসে। এই প্রতিষ্ঠানের বিদ্যার্থীরা, শিক্ষকমণ্ডলী, কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ মুক্তচিন্তা নিয়ে সব রকমের অসম্প্রীতি ও অসাম্যের বিরুদ্ধে সদা জাগরূক থাকেন। যে প্রতিষ্ঠান সম্প্রীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে এবং আজো জাতিকে নেপথ্য-নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে, সেই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা দিবসে এর সোনালি অর্জনসমূহ স্মরণ না করে প্রতিষ্ঠাকালীন শুধু সাম্প্রদায়িক কথকতা স্মরণ করলে প্রতিক্রিয়ার অন্ধকারে প্রগতির আলো ম্লান হয়ে যায়।

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।