জাগো বাহে কুণ্ঠে সবাই


প্রকাশিত: ০৪:৩৬ এএম, ২৯ জুন ২০১৬

হত্যা, ধর্ষণ এবং পাশবিকতা আমাদের সমাজে মহামারী আকার ধারণ করেছে। পাশবিক হত্যাকাণ্ড সমাজ সভ্যতার কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু আমাদের দেশে পাশবিকতা যেন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আড্ডায় চায়ের কাপে রবীন্দ্রনাথ নজরুল জীবনানন্দ অথবা সুকান্তকে কেউ  খোঁজে না এখন। একুশ, একাত্তর নব্বইয়ের সেই সব দিনের কথাও মানুষের চিত্তে দ্যোতনা তৈরি করে না। আঘাতে আঘাতে মানুষের অনুভূতি যেন অসাড় হয়ে গেছে। দুর্বল হয়ে গেছে মানবিক  চেতনা। মানুষের সহমর্মিতা, দায়িত্ববোধ এবং ভালোবাসা ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। মানবিক  চেতনার এই বিপর্যয় এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়।
 
সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরুদের কাছে নিরুপায়। পথে প্রান্তরে পড়ে থাকে পশু পাখির মতো। আট বছরের হত্যা হওয়া শিশু পানিতে ভাসে মুয়াজ্জিনের ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে। আমরা যাকে গুপ্তহত্যা বলে থাকি, এখন তা প্রকাশ্য হত্যা। প্রথা বিরোধী বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময় লেখক হুমায়ুন আজাদকে দিয়ে এই হত্যাযজ্ঞের শুরু হয় ২০০৪ সালে। তাঁর উপর এই বর্বরোচিত হামলার পর উত্থান হয় ভয়াবহ জঙ্গিবাদের। সে বছরই ঘটে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা। ২০০৭ সালে বাংলা ভাই ও তার বাহিনীর পতনের পর সাময়িক ভাবে জঙ্গিবাদ সাংগঠনিক ভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু জঙ্গিবাদকে আদর্শগত দিক থেকে  মোকাবেলা না করায় এর মূলোৎপাটন সম্ভব হয়নি।

শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার ছাড়া এর সমাধান সম্ভবত আদৌ সম্ভব নয়। যার ফলে ২০১৩ তে গণজাগরণ মঞ্চের উত্থান এবং এর কিছুকাল আগে অনলাইন এক্টিভিস্ট এবং ব্লগ লেখকদের সক্রিয় প্রকাশ ঘটলে জঙ্গিবাদ আবারো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। নতুন করে লেখক ও ব্লগারদের উপর আক্রমণ ও হত্যা শুরু হয়। এই আক্রমণের প্রথম শিকার আসিফ মহিউদ্দিন, যদিও কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। তাদের পরবর্তী লক্ষ্য রাজীব হায়দার প্রাণ হারান আসিফ মহিউদ্দিন হত্যা প্রচেষ্টার প্রায় একমাস পর। এর পরের ঘটনাগুলো কারো অজানা নয়। শুধু ব্লগার নয়, এখন শিক্ষক, ধর্মযাজক, পুরোহিত এবং প্রগতিশীল কোনো মানুষই বাদ যাচ্ছেন না। অধ্যাপক জাফর ইকবালের মতো নির্ভেজাল পক্ষপাতহীন একজন গুণীজনকেও পুলিশ প্রহরায় জীবন-যাপন করতে হয়।

পাশবিকতা কেবল ধর্ম আর রাজনৈতিক অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ নয়, সামাজিক এবং পারিবারিক পরিমণ্ডলেও এর বিস্তার ঘটেছে ভয়াবহ রূপে। গর্ভজাত সন্তানকে নিজ হাতে হত্যা এ সময়ের সামাজিক অস্থিরতা ও নৈতিক অবক্ষয়ের এক নতুন সংযোজিত বাস্তবতা। বছরের শুরুতে বনশ্রীতে প্রাক্তন কলেজ শিক্ষক জেসমিন গর্ভজাত দু’সন্তানকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। উজিরপুরে এক মা তার দেড় বছরের শিশু সন্তানকে গলা  কেটে হত্যা করেছে। মিরপুরে নেম আবাসিক এলাকায় এক গৃহকর্মীকে ধর্ষণ করে ছাদ থেকে ফেলে  দেয়া হয়েছে। এক গৃহকর্মী কিশোরীকে বাড়ীওয়ালা গর্ভবতী করে নবজাতককে ছাদ থেকে ছুঁড়ে  মেরেছে ঘটনা গোপন করার জন্যে। ২০১২ সালে চামেলীবাগের পুলিশ দম্পতির সন্তান কিশোরী ঐশী তার বাবা মা উভয়কে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে নিজ হাতে হত্যা করেছে।

এ সকল চিত্রই আমাদের সমাজের পরিবারের সম্পর্কগুলোর আস্থাহীনতা এবং হতাশার প্রতিচ্ছবি। পরিবারের একান্ত নিরাপদ আশ্রয় নিজ ঘরটি হয়ে উঠেছে দানবীয় হন্তারকের আবাস্থল। টার্গেট হত্যা তালিকায় অতি সম্প্রতি যুক্ত হলেন একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী যিনি ‘নাস্তিক ব্লগার নন’, নন কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। তিনি খুব সাধারণ, বিলাসহীন একজন ধার্মিক গৃহবধূ এবং দু’টি অবুঝ সন্তানের জননী। মায়ের হাতে হাত রাখা পরম আস্থার বন্ধন ছাড়িয়ে মাহমুদা খানম মিতুকে হত্যা করলো কিছু কাপুরুষ, মানুষ নামের পশু। তাঁর মৃত দেহ রাস্তায় পরে থাকলো হাজার হাজার মানুষের করুণা দৃষ্টি পেয়ে। যারা মিতুকে হত্যা করেছে তারা কোন ধর্মের অনুসারী, কাদের প্রতিনিধি?
 
পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী হওয়ার জন্য যারা তাকে নির্দয় ভাবে ছুরিকাঘাত ও গুলি করল, তারা কি মানুষ ছিলো, তারা কি কোনো নারীর গর্ভজাত সন্তান? মিতুর প্রতি এই নৃশংসতার পরেও যদি ইসলাম ধর্মের এই অপব্যবহারকারীদের চিহ্নিত ও প্রতিহত না করি, তাহলে আমরা ধর্মীয় এবং সামাজিক উভয় দায়িত্বের প্রতিই প্রতিশ্রুতিশীল নয় বলে প্রতীয়মান হবে। আমাদের এই দায়িত্বহীনতা ও অপারগতা আগামীকাল আমাদের শিশু সন্তানের জীবন বিপন্ন করবে এতে কোনো ভুল নেই।

আমরা যারা নিজেদের নিরাপদ মনে করে চুপ থাকছি, ভাবছি এ আগুনের উত্তাপ থেকে  বেঁচে যাবো তাদেরকে মনে করিয়ে দিতে চাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে জার্মান খ্রিস্টান ধর্মযাজক মারটিন নেইমোলার এর পরিণতির কথা। হিটলার যখন সমাজতন্ত্রীদের আক্রমণ করেন তিনি তখন নীরব ছিলেন, কারণ তিনি সমাজতন্ত্রী ছিলেন না, যখন ইহুদী নিধন শুরু হয়, তখনও তিনি নীরব ছিলেন কারণ তিনি ইহুদিও ছিলেন না। পরবর্তীতে তিনি নিজে যখন হিটলারের আক্রমণের শিকার হলেন, তখন তাঁর হয়ে আর প্রতিবাদ করার মতো কেউ ছিলোনা। কারণ ইতোমধ্যে হিটলার সবাইকে হত্যা বা কারাবন্দী করেছে। নগরে যদি আগুন লাগে তাহলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না।

লেখক : সহকারী ব্যবস্থাপক প্রশিক্ষণ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড
[email protected]

এইচআর/এবিএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।