কৃষকের কর


প্রকাশিত: ০৩:৪৬ এএম, ১৮ জুন ২০১৬

কৃষকদেরও কর দিতে হবে- সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীর এমন একটি বক্তব্য বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।  সামাজিক মাধ্যম, ব্লগ এমনকি টেলিভিশন টকশোতেও এ নিয়ে অর্থমন্ত্রীকে কেউ কেউ কটাক্ষ করেছেন।

মন্ত্রীর কথায় বোঝা গেলে দুই বছর পর কৃষকদের কাছ থেকে আয়কর আদায় শুরু করার পরিকল্পনা করছে সরকার। তবে তিনি বলেছেন, কৃষকদের আয়ের ওপর করারোপ করতে হবে, পুরো উৎপাদনের ওপর নয়৷ ‘‘এখন সময় হয়েছে আমাদের চাষী কিষাণরা, তাদেরও এখন ট্যাক্স দিতে হবে৷ কারণ এখন ‘বেশ বড় কৃষক` অনেক হয়ে গেছে৷ এলাকা বেশি হয় নাই, কিন্তু এলাকার প্রোডাক্টিভিটি এত বেড়েছে যে তাদের ওপর করারোপ করা যায়৷ যদিও এখন পর্যন্ত তারা কর অব্যাহতি পায়৷ তবে তাদের আয়ের ওপর করারোপ করতে হবে, পুরো উৎপাদনের ওপর নয়৷``

বর্তমানে চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীসহ অন্যান্য পেশাজীবীদের মধ্যে যাঁদের বাৎসরিক আয় আড়াই লক্ষ টাকার বেশি, তাঁদের কর দিতে হয়৷ কৃষকদের ক্ষেত্রে তাঁদের আয়ের উপর করারোপের কথা বললেও সেই সীমা কতখানি হবে, সেটি বলেননি অর্থমন্ত্রী৷ কৃষক হলেই যে তাঁকে কর দিতে হবে এমন মন্তব্য কি করেছেন অর্থমন্ত্রী? না করেননি। সরকার করদাতার সংখ্যা বাড়াতে চায়, কারণ ১৬ কোটি মানুষের দেশে কর দিচ্ছেন মাত্র কয়েক লাখ মানুষ। এই বাস্তবতায় আবেগের বাইরে গিয়ে বিচার করলে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। যে কোনো মানুষের আয়, তা তিনি কৃষক হোন বা অন্য কোন কাজ করুন, করযোগ্য হলে কেন কর দিবেননা এটি বোধগম্য নয়।      

কর হলো এমন বিষয় যা দায়িত্বশীল নাগরিক এড়িয়ে যেতে পারেন না। দেশে বহু কৃষক আছেন যারা খুব সাধারণ কৃষক নন। কারো কারো আয় ঈর্ষণীয়ভাবে অনেক। আর এদের কথাই অর্থমন্ত্রী বুঝিয়েছেন। আয় করযোগ্য হলে কর দেয়া বাধ্যতামূলক এবং এর বিনিময়ে কিছু চাওয়ারও নেই একজন নাগরিকের। যেসব সুবিধা সরকার নাগরিকদের জন্য দিবেন বলে দায়িত্ব নেন, যেমন, সুশাসন, নানা ধরনের সুবিধাদি তা করদাতার জন্য যেমনি, তেমনি যার আয় করযোগ্য নয় তার জন্যও।    

আইন সবার জন্য সমান এটি যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে পেশার ভিন্নতা থাকার সুযোগ নেই। ইদানিং বেশ বড় বড় কৃষকের খবর পাওয়া যাচ্ছে। শুধু নামের আগে কৃষক আছে বলে তারা অব্যাহতি পাবেন? অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নানাভাবে অর্থ আয় করে দেখাচ্ছেন তিনি কৃষক। তিনি করের আওতার বাইরে থাকবেন? অর্থমন্ত্রী এদের কথাই আসলে বলেছেন। এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় তিনি ঠিক কথাই বলেছেন। কোনো কোনো গণমাধ্যমে, আর ঢালাওভাবে সামাজিক মাধ্যমে যেসব মন্তব্য আসছে, সেসব আসছে প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করেই।


কর দু’ধরনের: প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ। ব্যক্তিগত বা কোম্পানি আয়কর হল প্রত্যক্ষ। এগুলি মেটায় ব্যক্তি বা সংস্থা। পরোক্ষ কর হল পণ্য বা সেবার সঙ্গে সম্পর্কিত। কর ব্যবস্থার একটা লক্ষ্য হল সমতা। সম্পন্ন নাগরিকদের আয়ের উপর তুলনায় বেশি হারে কর বসিয়ে এই লক্ষ্য পূরণ করা হয়।

এই প্রগতিশীল করের নীতি প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে এটা কিছুটা সম্ভব, যেমন তথাকথিত বিলাসদ্রব্যের উপর চড়া কর বসিয়ে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কোন জিনিসটা বড়লোকের ভোগ্য আর কোনটা গরিবের, সেই বাছবিচার করে কর বসানো খুব কঠিন। তাই করের হার নির্ধারণ করতে গিয়ে পণ্য এবং সবার সূক্ষ্ণ বিচার না করে একটা সাধারণ হারে কর বসানোই বিবেচনার কাজ। তাতে কর ব্যবস্থার সরলীকরণ হতে পারে, কর আদায়ের ব্যয়ও কমে। এবং এটা ধরে নেওয়াই ভাল যে পরোক্ষ কর দিয়ে সমতা আনা কঠিন, ওটা সব বর্গের মানুষের উপরেই এক ভাবে প্রযোজ্য হবে। সমতা বাড়াতে চাইলে পরোক্ষ করের তুলনায় প্রত্যক্ষ করের গুরুত্ব বাড়ানো দরকার।

এদেশে কর ছাড়ের গোটা ব্যবস্থাটাই খুব অযৌক্তিক, মর্জিনির্ভর, তদ্বিরনির্ভর এবং অস্বচ্ছ। কাকে, কোন খাতকে কেন কর রেয়াত দেয়া হচ্ছে তা পরিষ্কার নয় জনগণের কাছে। প্রত্যক্ষ করের বেলায়, বিশেষ করে, ব্যক্তি করের ক্ষেত্রেই বেশি করে ফাঁকির ঘটনা ঘটছে। কথাটি হলো করযোগ্য আয়। কৃষির সাথে সম্পর্কিত পেশাজীবীদের উৎপাদন আর নীট আয়ের মধ্যে যে ব্যবধান আছে তার বোঝাপড়াটা জরুরি বেশি। বড় কৃষকরা কেন আয়করের আওতার বাইরে থাকবেন বা এখনো আছেন তা বোধগম্য নয়।

হ্যা অনেকেই তর্ক করবেন যে, বাংলাদেশের এখনকার বাস্তবতায় ধানের বাজার মূল্য এতো কম যে তা দিয়ে উৎপাদন খরচই উঠেনা। ধান চাল তথা ফসলের একটি কার্যকর ক্রয় পদ্ধতি না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে ক্ষুদ্র আর প্রান্তিক কৃষকের যে সাধারণ বাস্তবতা তা প্রযোজ্য নয় বড় কৃষকদের বেলায়। বাংলাদেশে এখন প্রচুর বড় বড় রাজনৈতিক কৃষক রয়েছেন যারা এই কর ছাড়ের সুবিধা অন্যায়ভাবে ভোগ করছেন। ক্ষুদ্র কৃষকদের মতো এরা কেবল ফসলের উৎপাদন ও বিক্রির উপরই নির্ভরশীল নন।   

আর কৃষির অর্থতো শুধু ধান চাষ নয়। শহরের যে মানুষ গ্রামে বা প্রান্তিক এলাকায় বড় খামারের মালিক, যারা ফল, সবজি, ভূট্টা, স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফল,কলা,লিচু, আমের চাষ করেন তারাও কৃষকের তকমা লাগিয়ে কর রেয়াত নিচ্ছেন। কর না দেয়ার কোনো কারণ আছে কী তাদের? সমস্যা হবে একটি যৌক্তিক বিচার প্রক্রিয়া। শহরের বড় বড় প্রচুর ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী যেখানে নানা ছলচাতুরিতে কর ফাঁকি দিচ্ছেন, সেখানে কৃষকের কাছ থেকে কর আদায় কতটা সহজ হবে বোঝা কঠিন।    

অর্থমন্ত্রী বিষয়টি ভেবেছেন, এজন্য ধন্যবাদ। কারণ তনি ভাল করেই জানেন বাংলাদেশে আয় বাড়াতে হলে আয়কর দিয়েই বাড়াতে হবে। যার সক্ষমতা যত বেশি, তাকে তত বেশি কর দিতে হবে তা তিনি যে পেশাতেই থাকেন না কেন।  

syed-Ishtiaque-Reza

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।