মানহীন ওষুধ কোম্পানি বন্ধ করুন
মানসম্পন্ন ওষুধ প্রস্তুত না করার কারণে ২০টি দেশীয় ওষুধ কোম্পানির উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ সংক্রান্ত হাইকোর্টের আদেশ বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে ১৮ আগস্টের মধ্যে হাইকোর্টের জারি করা রুল নিষ্পত্তির জন্য নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এটি একটি ঐতিহাসিক রায়। আমরা আশা করবো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করে জনস্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে আসবেন।
গত ৭ জুন হাইকোর্ট এক আদেশে জিএমপি নীতিমালা অনুসুরণ করে ঔষুধ উৎপাদনে ব্যর্থ হওয়ায় ২০টি কোম্পানিকে উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ দেয়। এছাড়া আরো ১৪টি কোম্পানির সব ধরনের এন্টিবায়েটিক উৎপাদনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় আদালত। সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কর্তৃক গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি মানহীন ওষুধ কোম্পানির ওষুধ উৎপাদন ও লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করে। কিন্তু দীর্ঘ দিনেও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেনি সরকার। এ পরিস্থিতিতে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন ‘হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশের’ পে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে তিনটি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির করা আবেদনে খারিজ করে গতকাল বুধবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির আপিল বিভাগের বেঞ্চ এই আদেশ দেন। এর ফলে হাইকোর্টের নির্দেশ বহাল রয়েছে। একই সঙ্গে হাইকোর্টের জারি করা রুল আগামী ১৮ আগস্টের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে বলেছেন সর্বোচ্চ আদালত।
এটা অত্যন্ত ভয়াবহ ব্যাপার যে জীবনরক্ষাকারী ওষুধও এখন ভেজাল ও মানহীন। এসব ওষুধ খেলে রোগ-বালাই থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে তো দূরের কথা উল্টো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় জীবনহানির আশঙ্কা রয়েছে। নকল ও ভেজাল ওষুধ নিয়ে কম কথা হয়নি। কিন্তু এর বিপরীতে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনা সন্তোষজনক নয়। তবে আশার কথা হচ্ছে সর্বোচ্চ আদালতের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে রায় আসলো।
রোগব্যাধি হলে ওষুধ খেয়ে জীবন রক্ষা করে মানুষ। কিন্তু সেই ওষুধেও ভেজাল থাকাটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। মানহীন ও ভেজাল ওষুধ খেয়ে রোগ সারার বদলে আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, দেশে ওষুধের উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত কোনো স্তরেই সরকারি পরীক্ষাগারে মান নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয় না। বিপণনের পর অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বাজার থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠান। তখন ওষুধের মান জানা যায়। এর আগ পর্যন্ত পরীক্ষাহীন, মান না জানা ওষুধই ব্যবহার করে মানুষ। এভাবেই ওষুধ কোম্পানিগুলো এ দেশের মানুষকে রীতিমতো গিনিপিগে পরিণত করেছে। এক হিসাব দেখা যায়, প্রতিবছর ১২ হাজার আইটেমের ওষুধ বাজারে আসছে। কিন্তু ওষুধ প্রশাসনের যে লোকবল ও যন্ত্রপাতি রয়েছে তাতে তারা মাত্র সাড়ে তিন হাজার আইটেম ওষুধের নমুনা পরীক্ষা করতে পারে। বাকি ৭০ শতাংশ ওষুধের মান যাচাইহীন অবস্থায় রয়ে যায়।
দুঃখজনক হচ্ছে যে, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি ও বাজারজাত দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু-র মতে, ওষুধ উদ্ভাবনকারী ছাড়া জেনেরিক বা বর্গনামে ওষুধ প্রস্তুত করাই হচ্ছে নকল ওষুধ। তৃতীয় বিশ্বের প্রতিটি দেশেই বর্গনামে ওষুধ প্রস্তুত চলছে। ফলে ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। অনেক কোম্পানি জেনেশুনে জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। অথচ বাংলাদেশে ওষুধ একটি বিকাশমান শিল্প। ১০৭টি দেশে আমাদের তৈরি ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতেও ওষুধশিল্প বড় ভূমিকা রাখছে। শুধু তাই নয়, জীবন রক্ষাকারী মূল্যবান অনেক ওষুধও এখন আমাদের দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। সার্বিক বিবেচনায় শুধু জনস্বার্থই নয়, কোম্পানিগুলোর নিজ স্বার্থেও ওষুধের মান ঠিক রাখা অত্যন্ত জরুরি।
মনে রাখা দরকার ওষুধ কোনো সাধারণ পণ্য নয়। জীবন রক্ষার জন্য ওষুধের গুরুত্ব অপরিসীম। এজন্য ওষুধ কোম্পানিগুলো যাতে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে সেটি জোর নজরদারিতে রাখতে হবে। এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন করার কোনো বিকল্প নেই। স্বাস্থ্যখাতে সরকারের অর্জন কম নয়। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে সেটি ভেস্তে যাক এটি কাম্য হতে পারে না। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এ বিষয়ে আমরা সরকারের কঠোর অবস্থান দেখতে চাই।
এইচআর/এবিএস