মানবতাবাদী বীরের বিদায়
ছোটবেলায় একবার তার প্রিয় সাইকেলটি হারিয়ে যায়। আর তা চুরি করে তার চেয়ে বয়সে কিছুটা বেশি এবং শারীরিকভাবেও শক্ত সামর্থ্য আরেক কিশোর। তার কাছ থেকে সাইকেল ফিরিয়ে আনা এবং চুরির শাস্তি নিজ হাতে দেওয়ার শপথ করেন তিনি। কিন্তু শারীরিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিভাবে পারা যাবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। সাহায্য করেন এক পুলিশ অফিসার। বক্সিং শিক্ষার পরামর্শ দেন। এবং নিজেও সহযোগিতা করেন। মোহাম্মদ আলীর বীর মুষ্ঠিযোদ্ধা হয়ে উঠার শুরুটা ছিল এরকমই। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বিশ্ব মুষ্টিযুদ্ধের ইতিহাসে জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন। গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার ফিনিক্স-এরিয়া হাসপাতালে তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হলো এক মানবতাবাদীর বর্ণাঢ্য জীবনের। তবে তার নীতি আদর্শ ও সর্বোপরি মানবতার পক্ষে তিনি যে জয়গান গেয়ে গেছেন সেই চেতনাধারায় তিনি অমলিন থেকে যাবেন।
সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে তার প্রতিদ্বন্দ্বী আর কেউ ছিল না। শুধু বক্সিং দিয়েই বিশ্ব জয় করেছেন মোহাম্মদ আলী। জয় করেছেন মানুষের হৃদয়। ১৯৬০ এর দশকে যখন ক্যারিয়ারের তুঙ্গে তখনই তিনি জাতীয় চেতনায় বিশাল এক বিপ্লব নিয়ে আসেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে। এরপর থেকেই মোহাম্মদ আলী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে এক শক্তি, বাগ্মিতা, বিবেক এবং সাহসের প্রতীক হয়ে ওঠেন। ১৯৬৪ সালে ইসলামি সংগঠন নেশন্স অব ইসলামে যোগ দেন এবং ১৯৭৫ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন রাষ্ট্রীয় সীমানা ছাড়িয়ে, জাতি এবং ধর্মকে ছাপিয়ে সার্বজনীনতার প্রতীক। যাদের বিপক্ষে তিনি লড়াই করেছেন, তারা সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে গেছেন হয়তো; কিন্তু আজীবনই একজন যোদ্ধা ছিলেন মোহাম্মদ আলী।
১৯৪২ সালে কেন্টাকির লজভিলে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম রাখা হয়েছিল বাবা ক্যাসিয়াস মারকেলাস ক্লে সিনিয়র-এর নাম অনুসারেই। যার নামকরণ করা হয়েছিল একজন দাসপ্রথা বিরোধী রাজনীতিবিদ ক্যাসিয়াস ক্লে এর নামানুসারে। ১২ বছর বয়সেই বক্সিং শুরু করেন মোহাম্মদ আলী। ১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিকের আগেই গোল্ডেন গ্লাভস জয় করে ফেলেন আলী। এরপর অলিম্পিকে গিয়ে লাইট হেভিওয়েটে জেতেন গোল্ড মেডেল। ১৯৬৪ সালে প্রবল প্রতাপশালী মুষ্টিযোদ্ধা সনি লিস্টনকে পরাজিত করে তিনি পান বিজয়ী হন। এর তিন বছর পর ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নেওয়ার নির্দেশ এলে তিনি তা পালন করেননি বলে তার খেতাব কেড়ে নেওয়া হয়। এ সময় তিন বছর তিনি আর পেশাদারি মুষ্টিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। তবে সারা বিশ্বের মানবাধিকারকর্মীরা আলীর পাশে এসে দাঁড়ান। বর্ণবাদবিরোধী এবং নাগরিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামেও তার ভূমিকা ছিল অনন্য।
১৯৭৮ সালের দিকে এসেছিলেন বাংলাদেশেও। নাগরিকত্বও দেয়া হয়েছিল মোহাম্মদ আলীকে। সে সময় বাংলাদেশ সফরে এসে বলেছিলেন- ‘যদি স্বর্গ দেখতে চাও, তাহলে বাংলাদেশে যাও’। তার মৃত্যুতে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও নেমে এসেছে শোকের ছায়া। বাংলাদেশের মানুষ এই মানবতাবাদী বীর মুষ্টিযোদ্ধাকে কোনোদিন ভুলবেনা।
এইচআর/এমএস