নারী পতিতা নয়, পতিতা আসলে নষ্ট পুরুষ
মানব সভ্যতা এগিয়ে চলছে। প্রযুক্তির ব্যবহার এই উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আবার প্রযুক্তির অপব্যবহারও হাত ধরাধরি করে বেড়ে চলেছে। সেই সাথে মানুষের মধ্যে বাড়ছে নৈতিক অবক্ষয় আর নির্মমতা। হত্যা, আত্মহত্যা, নারী ও শিশু ধর্ষণের মতো এক একটি নিগ্রহের ঘটনায় আমরা প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছি। একটি বিভীষিকাময় ঘটনা দ্রুত ভুলিয়ে দিচ্ছে আরেকটি ঘটনাকে। সেই সাথে আমাদের আবেগের তীব্রতা এসব নির্মম ঘটনাগুলির প্রতি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। নির্যাতনের সমসাময়িক ঘটনাগুলির বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ঘাতক হচ্ছে নৈতিকতাহীন পুরুষ। যার নিষ্ঠুর নির্মম শিকার হচ্ছে নারী ও নিষ্পাপ শিশু। অধঃপতিত পুরুষের এই স্খলন সমাজের অস্থিমজ্জায় ছড়িয়ে দিচ্ছে গুপ্তঘাতক কর্কট ব্যধি।
আমাদের দেশে আত্মহত্যার তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে যার অগ্রভাগে রয়েছেন হালের উঠতি তারকারা। সমাজে তারা একটি পাকাপোক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে সক্ষম হলেও সামাজিক মূল্যবোধ ও নারীর প্রতি বৈষম্যের কারণে এখনো তারা বাংলা ছবির নায়িকা সুলভ চিরায়ত চরিত্রটি ধারণ করে বসে আছেন। আমাদের দেশের নারীরা আধুনিক, শিক্ষিত এবং আত্মনির্ভরশীল হলেও চেতনাগত ভাবে এখনো তারা পুরুষতন্ত্রের দেয়াল ভেঙে নিজেদের মুক্ত করতে পারেননি। শুধু আমাদের দেশেই নয়, ভারতেও আত্মহত্যার প্ররোচনায় বলি হয়েছেন সিল্ক স্মিতা, পারভিন ববি, দিব্যা ভারতীর মতো নামকরা অভিনয় শিল্পীরা।
কয়েক বছর আগে জিয়া খান নামের একজন ভারতীয় অভিনেত্রী তার ছেলে বন্ধুর অনৈতিক নিষ্ঠুর সম্পর্কের চরম বলি হয়ে আত্মহত্যা করেন। এরপরেও অতি সম্প্রতি গত কয়েক মাস আগে কলকাতার বাংলা নাটক ‘বালিকা বধূর’ নায়িকা প্রত্যুশা ব্যানার্জী। এদের সকলের জীবনের পরিণতিই প্রায় এক রকম। বাংলাদেশের মিতা নূরও এই তালিকায় আছেন। অনেক নারী স্বামীর চাইতে মেধাবী হয়েও এখনো চার দেয়ালের মাঝেই বন্দী হয়ে আছে। এখনো অনেক প্রগতিশীল, আত্মনির্ভরশীল নারী কন্যা সন্তানের জন্ম সহজে মেনে নিতে পারেন না। যার দরুণ হাজার নিপীড়ন মেনে নিয়েও তারা পুরুষ সঙ্গীকে সারাজীবন আগলে রাখতে চান। নারীর এই দুর্বলতার সুযোগটি কড়ায় গণ্ডায় আদায় করে নিচ্ছে বহুগামী পুরুষ।
মডেল সাবিরা হোসেনের আত্মহত্যা গণমাধ্যমে এখন প্রধান আলোচ্য বিষয়। প্রজাপতির মতো মেয়েটি একটি প্রতারক ছেলের জন্য ফেসবুকে ভিডিও আপলোড করে আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে সত্যিই আত্মহত্যা করলেন! আমরা বাংলাদেশের সকল জনগণ তা নয় মিনিট ধরে সিনেমার দৃশ্যের মতো চেয়ে চেয়ে দেখলাম। কিছুই করতে পারিনি মেয়েটির জন্যে। আবেগপ্রবণ, অভিমানী এবং প্রখর আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মেয়েটি প্রতারিত হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি।
সমাজ তাকে শেখায়নি যে প্রস্টিটিউট নারী নয়, প্রস্টিটিউট হচ্ছে পুরুষ। সাবিরা হয়তো কেবলমাত্র প্রেমে প্রতারিত হওয়ার জন্যই নয়, আতংকিত হয়েছেন ব্ল্যাকমেইল হবার ভয়ে। প্রেমিক পুরুষের অধঃপতিত, স্খলিত এই রূপ তাই সহজে মেনে নিতে পারেনি মেয়েটি। প্রশ্ন জাগে জীবনের প্রতি এই মূল্যবোধ তাকে কে দিলো যে প্রেমিক ছাড়া জীবনে আর কিছুই চাওয়া পাওয়া নেই?
রিমান্ডে কথিত প্রেমিক নির্ঝরের প্রতারণা আর নিষ্ঠুরতার আসল কাহিনী বের হতে শুরু করেছে, যা সমাজে খুব নতুন কিছু নয়। কথা হচ্ছে সাবিরার এই আত্মহত্যা কি শুধু প্রতারিত হওয়ার বেদনায়ই ঘটেছে, নাকি এর মধ্যে ছিল নারীর শরীরকে অপব্যবহার করার তীব্র যন্ত্রণা আর অপমান বোধ? প্রেমিক নির্ঝরের বাবা-মা কি জানেন যে অনৈতিক ব্যবসায় নেমেছে তাদের সন্তান, যার কারণে সাবিরাকে তাদের আরেক সন্তান প্রত্যয়ের মুখ থেকে শুনতে হয় প্রস্টিটিউট গালি? ঘটনাগুলো একান্ত ব্যক্তিগত হলেও সামাজিক মূল্যবোধ কিন্তু ব্যক্তিগত নয়। সে হিসেবে বলা যায় আত্মহত্যা যেন হত্যারই অন্য পিঠ। ক্রমবর্ধমাণ ধর্মীয় প্রসারতা এখন শুধু লেবাসের মধ্যে সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার মাত্র। তাই নৈতিক অবক্ষয় নিবৃত্তিতে ধর্মীয় চেতনাও তেমন কোন ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ধর্মীয় দর্শনের আড়ালে ঢেকে যাচ্ছে মানব ধর্ম।
মডেল সাবিরাকে নিয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে ইডেন মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জাহিদা মেহেরুননেসা বিক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন, ‘মেয়েদেরকে সতর্ক করার জন্য নারী শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে। নারীদেরকে আত্মহত্যার বিষয়ে সতর্কতা ও সচেতনামুলক শিক্ষা দিতে হবে। এ ধরনের সচেতনতা ও সতর্কতা নারীর নৈতিকতা গঠনে ও আত্মবিশ্বাস তৈরিতে সাহায্য করবে। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে যৌবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়ে একে অপরের প্রতি ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এ ভালোবাসায় আছে দায়, আছে প্রতিশ্রুতি। এখানে পরস্পরের অনভূতিকে সম্মান করার বিষয়টিই সম্পর্কের মুল ভিত্তি।’
জীবন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ছেলে-মেয়েদের অনেক রকম ঝুঁকি আর সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এই বয়সেই নানারকম বিপদ তাকে হাতছানি দিতে থাকে। মাদকদ্রব্য, রাজনৈতিক অপব্যবহার, অর্থ উপার্জনের নানারকম পিচ্ছিল পথের প্রতি আকর্ষণ কাজে লাগিয়ে মেয়েদেরকে বলির পাঁঠা হিসেবে বিক্রি করার সাথে সাথে বিক্রি হয় তার মর্যাদা। জীবনের এই সন্ধিক্ষণে তাদের প্রয়োজন হয় ভালবাসার বন্ধন, যা বাবাও অনেক সময় যথাযথ ভাবে নির্দেশনা দিতে পারেন না। কিন্তু একজন শিক্ষক তা পারেন। নারীকে নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে যে সে যেন তার পুত্রসন্তানদের নারীর প্রতি উদার মনোভাবাপন্ন করে গড়ে তুলতে পারে।
আর নারীকেও বুঝতে হবে সতীত্বের ধারণাটিই বেঁচে থাকার একমাত্র নির্ধারক না। ধর্ষিত নারীর কলঙ্কও নারীর নিজের নয়। নারীর শরীর অন্য পুরুষের লালসা সৃষ্টি করে সেজন্য নারী দায়ী নয়। দায়ী লোভী পুরুষের হীন মানসিকতা। সার্বিকভাবে নারীকেই নারীর প্রধান অবলম্বন হতে হবে। নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেন কোনো পুরুষ তাকে অপমান করতে না পারে তার জন্য নারীদের আত্মমর্যাদা ও আত্মরক্ষার কৌশল শিখতে হবে। নারীকে বুঝতে হবে অপকর্মের হোতা কোনো একক পুরুষ নয় বরং সার্বিক পুরুষ গোষ্ঠী। অপরাধী পুরুষেরাই ঐ দুর্বৃত্ত পুরুষকে বাঁচায় কিন্তু নারীটি তার নিজের বাবা-মায়ের কাছেও আশ্রয় পায় না। তাই ধোয়া তুলসী পাতা হবার জন্য হত্যা বা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়া নিরেট অর্থহীন এবং পুরুষ তন্ত্রের হাত শক্তিশালী করার নামান্তর। নারী যত দ্রুত এই সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে, ততো দ্রুতই তার মুক্তি।
লেখক : সহকারী ব্যবস্থাপক প্রশিক্ষণ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড
এসএইচএস/আরআইপি