মহাবিশ্ব কি এখনও অধরাই?

এই মহাবিশ্বে অনেক কিছুই এখনও অদেখা ও অজানার আছে। তাই মানুষ বরাবরই এই অদেখা ও অজানাকে জানতে চায়। ভেদ করতে চায় সৃষ্টির রহস্য তত্ত্বকে। উন্মোচন করতে চায় মহাবিশ্বের মহা সত্তাকে।আবার মাঝে মাঝে জীবন ও বিসর্জন দেয় এসব রহস্য উদ্ঘাটন করতে। তবুও কি মানুষকে দমিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে? নাকি অজানাকে জানার তৃষ্ণা নেভানো গেছে?
নাসার গবেষক ও বিজ্ঞানী সুনীতা উইলিয়ামস এবং বুচ উইলমোর এই দুই জন আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে গেছেন আট দিনের জন্য। উদ্দেশ্য ছিল মহাকাশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা। কিন্তু কেন তাদের আটকে থাকতে হলো ন’মাস? মূল কারণ কি? তদন্তে বেরিয়ে এসেছে যে-রকেট তাদের উড়িয়ে নিয়ে গেছে, সেই রকেটেই দেখা দিয়েছিল যান্ত্রিক ত্রুটি। আবার নতুন রকেট পাঠিয়ে তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে লেগে গেল ন-ন’টি মাস। এসব কিছু সম্ভব হয়েছে মার্কিন নবনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগ্রহের জন্য। ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য এই বিলম্বের জন্য দায়ী করেছেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যর্থতাকে। ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই ‘বন্ধু’ ইলন মাস্ককে অনুরোধ করেন, তিনি যেন তার ‘স্পেসএক্স’ সংস্থার মহাকাশযান ‘ক্রু ড্রাগন’ পাঠিয়ে যত দ্রুত সম্ভব সুনীতা-বুচকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনেন। সেই ব্যবস্থা করা বাস্তবে সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ সময় বুধবার ভোররাত ৩টা ৫৭ মিনিটে স্পেসএক্স-এর মহাকাশ সুনীতাদের নিয়ে ফ্লোরিডা উপকূলের কাছে মহাসমুদ্রে নেমে গেছে। সাথে সাথে তা হয়ে গেল ইতিহাসের সাক্ষী।
সুনীতাদের জন্য পৃথিবী ব্যাকুল প্রতীক্ষায় ছিল। মর্তের দুই মানব-মানবী দীর্ঘকাল মহাশূন্যে কাটিয়ে ফিরে এসেছে পৃথিবীতে। সেই সঙ্গে ফিরেছে তাদের অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার মহাশূন্য– কেমন কেটেছে তাদের এই পর্ব? যদিও এই নিয়ে রয়েছে বিস্তর জিজ্ঞাসা। তারা কি খেয়েছে আর না খেয়েছে? কীভাবে সময় অতিবাহিত করেছে ? রয়েছে নানা কৌতূহল ও জল্পনা। শেষমেষ সকল জল্পনা কে সত্যি করল তারা। রচিত করলো মানব ইতিহাস। মহাকাশে স্বর্ণাক্ষরে নিজেদের নামও লিখে আসলেন।
সুনীতাদের অভিজ্ঞতায় পৃথিবীতে নিঃসন্দেহে এল এক নতুন মহাবিশ্ব, যা অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে মহাবিশ্বে প্রাণসন্ধানের রূপকথাকে। প্রার্থনা ছিল, সুনীতারা সবাই যেন ভালোয়-ভালোয় পৃথিবীতে ফিরে আসেন। সেটা ঘটার পর এবার অপেক্ষা শুরু। তাদের মুখ থেকে, তাদের ব্যক্তিগত বার্তায় যেন আমরা জানতে পারি মহাশূন্যের প্রাণময়তার কথা। আর সেই সঙ্গে জানতে পারি, দূরের আকাশে ঠিক কেমন দেখায় আমাদের পৃথিবীকে!
পৃথিবীর সময় থেকে অনেক দূরে ন’মাস কি হারায় তাদের দৈর্ঘ্য? কিংবা মনে কি হয় পৃথিবীর সময় মহাকাশের কালের চলনে সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়? মহাবিশ্ব নিয়ে রয়েছে বিচিত্র সব প্রশ্ন, বিচিত্র সব উত্তর। যা নিয়ে জিজ্ঞাসা কখনো শেষ হবার নয়। যেমন এই যে মহাকাশে গেলে অনুভূতি কেমন লাগে? নস্টালজিয়া কিংবা শিহরন? এই মহাবিশ্বে কোথাও প্রাণের চিহ্ন আছে কী না? তারই সন্ধান কীভাবে পাওয়া যাবে? রাতের আকাশে, হাজার-হাজার আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রবীথির দিকে তাকিয়ে যুগে যুগে একটি প্রশ্ন মানুষের মনে জেগেছে, সৃষ্টি রহস্যের শিকড়ে জড়িয়ে থাকা আদিম প্রশ্ন– মহাবিশ্বে ‘প্রাণ’ বলতে শুধুই কি আমরা? তা কী হতে পারে? প্রাণ আছেই আছে। কিন্তু মহাবিশ্বের কতটুকু জানি আমরা? এই জানার পথে প্রধান অন্তরায় মহাবিশ্বের লক্ষ-লক্ষ আলোকবর্ষ দূরত্বের অকল্পনীয় বিস্তার! কিন্তু তবু মানুষ পৃথিবী ছেড়ে মহাকাশে ধেয়ে যাচ্ছে বারবার। পাঠাচ্ছে পৃথিবীর বার্তা গ্রহে-গ্রহে। মহাকাশ আবিষ্কারে ছুটছে আধুনিক বিজ্ঞান, বৈজ্ঞানিক ভাবনা ও কল্পনাতে।
সুনীতাদের অভিজ্ঞতায় পৃথিবীতে নিঃসন্দেহে এল এক নতুন মহাবিশ্ব, যা অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে মহাবিশ্বে প্রাণসন্ধানের রূপকথাকে। প্রার্থনা ছিল, সুনীতারা সবাই যেন ভালোয়-ভালোয় পৃথিবীতে ফিরে আসেন। সেটা ঘটার পর এবার অপেক্ষা শুরু। তাদের মুখ থেকে, তাদের ব্যক্তিগত বার্তায় যেন আমরা জানতে পারি মহাশূন্যের প্রাণময়তার কথা। আর সেই সঙ্গে জানতে পারি, দূরের আকাশে ঠিক কেমন দেখায় আমাদের পৃথিবীকে!
মহাকাশে দীর্ঘ দিন কাটানো নভোচারীর তালিকায় সুনীতা, বুচ প্রথম নন। অতীতেও আরও কয়েক জন মহাকাশচারীর সঙ্গে এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে। উপায় ছিল না ফেরার, দিনের পর দিন থেকে যেতে হয়েছে মহাকাশ স্টেশনে। ইতিহাস ঘাঁটলে প্রথমেই যে নামটা আসে, তিনি হলেন সেরগেই ক্রিকালেভ। ১৯৯১ সালের ১৮ মে মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বাসিন্দা। শুধু একা সেরগেই নন, তার সঙ্গে ছিলেন আরও দুই মহাকাশচারী। মহাকাশ স্টেশন ‘মির’ (এমআইআর)-এ থাকার কথা ছিল তিন মহাকাশচারীর। চার মাস থাকার কথা ছিল তাদের। ‘মির’ ছিল সোভিয়েত পরিচালিত বিশ্বের প্রথম আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন মহাকাশ স্টেশন। যেখানে থেকে মহাকাশচারীরা গবেষণা সংক্রান্ত কাজ করতে পারতেন। কিছু প্রযুক্তিগত কাজের জন্য সেখানে পাঠানো হয়েছিল সেরগেইকে। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তিনি অংশ নিয়েছিলেন ওই অভিযানে।
এবারে সুনীতা উইলিয়ামস এবং বুচ উইলমোরের মহাকাশ যাত্রা নিশ্চয়ই আগামী দিনের জন্য একটি বড় বার্তাও বটে। বিজ্ঞানময় এই সমাজে প্রযুক্তির উৎকর্ষ যেমন বেড়েছে, তেমনি মহাকাশে আমাদের দুঃসাহসিক অভিযান ও বেড়েছে। তবে এখনো আমরা মহাজাগতিক বিষয় নিয়ে অনেক পিছিয়ে আছি। জানার অনেক কিছু এখনো বাকি। এই ধরনের অভিজ্ঞতা ও অভিযান নিশ্চয়ই আমাদের সঞ্জীবনী শক্তি দিবে। এসব বিজয় গাথা যতই আমরা রচিত করতে পারবো ততই আমরা এই মহাবিশ্বকে নিরাপদ রাখতে পারবো।
লেখক : গণমাধ্যম শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
vprashantcu@gmail.com
এইচআর/জিকেএস