ব্যবহারে বংশের পরিচয়, ৫৪ ধারায় পুলিশের!


প্রকাশিত: ০৪:১৪ এএম, ২৫ মে ২০১৬

শুধু অপব্যবহারের কারণে একটি দরকারি আইনও যে খারাপ হয়ে যেতে পারে সেটির দৃষ্টান্ত হলো ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা। ১১৮ বছর আগের আইনের এ ধারাটি বৃটিশ সরকার, পাকিস্তান সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের সব সরকার অপব্যবহার করে এসেছে। শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালতে ১৮ বছর লড়াই করে একটি নির্দেশনা পেতে যাচ্ছে এদেশের মানুষ।

৫৪ ধারার কোথাও বলা নেই পুলিশ যে কাউকে যে কোনো কারণে যে কোনো সময় ওয়ারেন্ট ছাড়া আটক করতে পারবে। বরং বলা আছে, আমলযোগ্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তি বা এরূপ জড়িত বলে যার বিরুদ্ধে যুক্তিসঙ্গত অভিযোগ করা হয়েছে অথবা বিশ্বাসযোগ্য খবর পাওয়া গেছে অথবা যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ রয়েছে।

দ্বিতীয়ত: আইনসঙ্গত কারণ ব্যতীত যার কাছে ঘর ভাঙার কোনো সরঞ্জাম রয়েছে সেরূপ ব্যক্তি।

তৃতীয়ত: ফৌজদারী কার্যবিধি অনুসারে অথবা সরকারের আদেশে যাকে অপরাধী ঘোষণা করা হয়েছে।

চতুর্থত: চোরাই বলে যুক্তিসঙ্গতভাবে সন্দেহ করা যেতে পারে এমন মালামাল যার কাছে রয়েছে এবং তা নিয়ে কোনো অপরাধ করেছে বলে যুক্তিসঙ্গভাবে সন্দেহ করা যেতে পারে।

পঞ্চমত: পুলিশ অফিসারকে তার কাজে বাধাদানকারী ব্যক্তি অথবা যে ব্যক্তি আইনসঙ্গত হেফাজত থেকে পলায়ন করেছে অথবা পালানোর চেষ্টা করে।

ষষ্ঠত: বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী থেকে পলায়নকারী বলে যাকে যুক্তিসঙ্গতভাবে সন্দেহ করা যেতে পারে।

সপ্তমত: বাংলাদেশে করা হলে অপরাধ হিসেবে শাস্তিযোগ্য হতো, দেশের বাইরে এমন অপরাধে জড়িত ব্যক্তি অথবা জড়িত বলে যার বিরুদ্ধে যুক্তিসঙ্গত অভিযোগ করা হয়েছে অথবা বিশ্বাসযোগ্য খবর পাওয়া গেছে অথবা যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ রয়েছে। যার জন্য সে প্রতর্পণ সম্পর্কিত কোনো আইন অথবা ১৮৮১ সালের পলাতক অপরাধী আইন অনুসারে অথবা অন্য কোনোভাবে বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হতে অথবা হেফাজতে আটক থাকতে বাধ্য।

অষ্টমত: গুরুতর অপরাধীরা খালাস পাওয়ার পর আদালতের দেয়া নিয়ম ভঙ্গ করলে এবং

নবমত: যাকে গ্রেপ্তারের জন্য অন্য কোনো পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে অনুরোধ পাওয়া গেছে অথবা কোনো অপরাধ বা অন্য যে কোনো কারণে গ্রেপ্তার করা হবে সে ব্যাপারে অনুরোধ প্রেরণ করা হয়েছে সেই ব্যক্তিকে আইনসঙ্গতভাবে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারবেন।

৫৪ ধারায় আটকের এই নয়টি ভিত্তি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় পুলিশকে গণহারে গ্রেপ্তার করার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। এই ধারা ব্যবহার করার সময় অর্থাৎ কাউকে ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তারের সময় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সন্দেহ করার যুক্তিসঙ্গত কারণ বা বিশ্বাসযোগ্য সন্দেহ থাকতে হবে।  কিন্তু বছরের পর বছর সরকারগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশে এই ধারার ব্যবহার করেছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই বিরোধী দলের কর্মীদের কারাগারে আটকে রাখার জন্য গণহারে এই ধারা ব্যবহার করা হয়েছে। যখন সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই ধারাটি ব্যবহার করা শুরু করে তখন পুলিশও সুযোগ নেয়। তারা নিরীহ মানুষকে আটক করে তার কাছ থেকে অর্থ আদায় করা শুরু করে। যেটা গ্রেপ্তার বাণিজ্য বলে পরিচিতি পায়।

পুলিশও যে এ বিষয়টি অস্বীকার করে তা নয়। গত বছর ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার ৫৪ ধারার অপব্যবহার করে নিরীহ লোকজনকে গ্রেপ্তার এবং তা নিয়ে বাণিজ্য বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তার নির্দেশনাপত্রে বলা হয়েছে …নিরীহ জনগণকে গ্রেপ্তার করে তাদের নিয়ে বাণিজ্য ও মামলায় আসামি করে হয়রানি করছে কতিপয় অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা। এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রচার হওয়ায় বাংলাদেশ পুলিশ ও ডিএমপির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে…।

পুলিশ এই অপকর্মটি করার সুযোগ পেয়েছে আসলে রাজনৈতিক কারণেই। কিন্তু তাদের অপকর্মের মাত্রা এমন বেড়ে গিয়েছিল যে লাগাম টানা যাচ্ছিল না। ৫৪ ধারার জন্মের ঠিক ১০০ বছর পর ১৯৯৮ সালে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে এই ধারা ব্যবহার করে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন চালালে ওই বছরের ২৩ জুলাই মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে তার মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার পর বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। তদন্ত শেষে কমিটি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে কয়েকটি সুপারিশ করে। কিন্তু রাজনৈতিক অপব্যবহার বন্ধ হয়ে যাবে ভেবে সরকার কোনো সুপারিশই বাস্তবায়ন করেনি।

সেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় মানিবাধিকার কর্মীরা হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট এ বিষয়ে কয়েক দফা নির্দেশনা দেয়। যার মধ্যে ছিল, আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেওয়ার জন্য কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা যাবে না, গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে, তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে কারণ জানাতে হবে, বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেপ্তার ব্যক্তির নিকট আত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে বিষয়টি জানাতে হবে, গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে তার পছন্দ অনুযায়ী আইনজীবী ও আত্মীয়দের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে, গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে কারাগারের ভেতরে কাচের তৈরি বিশেষ কক্ষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। ওই কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকট আত্মীয় থাকতে পারবেন, জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবে। বোর্ড যদি বলে ওই ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে তাহলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা নেবেন এবং তাকে দণ্ডবিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে।

এসব নির্দেশনা ছয় মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে বলছিল হাইকোর্ট। এরপরেও সরকার তা মানেনি বরং ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে। শেষ রক্ষা হয়নি। আপিল বিভাগ বলেছে হাইকোর্টের সুপারিশগুলো আরো ঘষামাঝা করে একটি নীতিমালা ঠিক করে দেবে।

এখন আপিল বিভাগ যে নীতিমালা করে দিবে তা মানতে বাধ্য থাকবে সরকার। অথচ সরকারের দায়িত্ব ছিল জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করা। সরকারগুলো বারবার আইনের অপব্যবহার করায় উচ্চ আদালত বাধ্য হয়েই আজ সরকারকে আইন সংশোধন করতে বাধ্য করছে।

শুরুতে যে কথা বলছিলাম ৫৪ ধারা একটি দরকারি আইন এবার সেটিরও একটু ব্যাখ্যা দেয়া দরকার। কারণ কোথাও কোনো অপরাধী ঘোষণা দিয়ে অপরাধ করে না। আগে থেকে কোনো বিষয়ে মামলাও করা যায় না। কোনো কোনো সময় অপরাধীরা মামলা হওয়ার আগেই গ্রেপ্তার আতঙ্কে পালানোর চেষ্টা করতে পারে, সেক্ষেত্রে তাকে আটক করতে হলে ৫৪ ধারার ব্যবহার করতেই হবে। তাই এ ধারাটির প্রয়োজন সবসময় থাকবে। কিন্তু এই ধারা ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে যাতে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার খর্ব না হয়। আর পুলিশের সন্দেহবাতিকগ্রস্থতা কমাতে হবে।  

লেখক : সম্পাদক, ডিবিসি নিউজ

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।